নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা মানুষের একটি অধিকার। রাজনৈতিক কারণে যখন কোন ব্যক্তি দেশে হয়রানির শিকার হয় কিংবা বিতাড়িত হয়, যে অবস্থায় দেশে তার জীবন হুমকির সম্মুখীন বলে মনে করে সে অবস্থায় সেই ব্যক্তি ভিন্ন কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারে এবং প্রার্থিত দেশ তাকে আশ্রয় দিতে পারে। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান ও আশ্রিত ব্যক্তির সার্বিক নিরাপত্তা বিধান সে দেশের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৪ নং অনুচ্ছেদে জাতিসংঘ দ্বারা আশ্রয়ের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক আশ্রয় দু’ধরনের হতে পারে ভূখণ্ডগত আশ্রয় (territorial asylum) ও ভূখণ্ড বহির্ভূত আশ্রয় (non -territorial asylum)। কোন বিদেশী নাগরিককে দেশে প্রবেশের এবং বসবাসের অনুমতি প্রদানের রীতিকে ভূখণ্ডগত আশ্রয় বলে। প্রাচীনকালে রোম থেকে কেউ পালিয়ে গেলে ঐ পলাতক ব্যক্তি অন্য দেশে ভূখণ্ডগত অধিকার লাভ করত। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আদেশ বলে আন্তর্জাতিক আইন কমিশন কর্তৃক ১৯৬৭ সনের ১৪ ডিসেম্বর ভূখণ্ডগত আশ্রয় সংক্রান্ত একটি বিধান গৃহীত হয়। এ ঘোষণা অনুসারে নির্যাতন, যন্ত্রণা, ক্লেশ, রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তি অন্য যে কোন দেশে আশ্রয় খুঁজতে পারে। পক্ষান্তরে ভূখণ্ড বহির্ভূত আশ্রয় বলতে – বিদেশী দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনে আশ্রয়, এবং- আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় ও – যুদ্ধ জাহাজে আশ্রয় এবং বাণিজ্যিক জাহাজে আশ্রয় বোঝায়। যখন কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের ভিতরে অবস্থিত অন্য দেশের দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে তবে তা বিদেশী দূতাবাসে আশ্রয় বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে আশ্রয় অনুমোদনের ক্ষমতা কোন বিদেশী দূতাবাস প্রধানের নেই। রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে কেবলমাত্র ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে বিদেশী দূতাবাসে আশ্রয় লাভের অধিকার চালু রয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক আইনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় লাভের কোন বিধান নেই। তবে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান কোন ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দিতে পারে।
অপরদিকে কোন ব্যক্তি রাজনৈতিক অপরাধে অপরাধী হয়ে যদি নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় সংশ্লিষ্ট দেশের সমুদ্র তীরে নোঙর করা কোন বিদেশী যুদ্ধ জাহাজে আশ্রয় নেয়, তবে জাহাজের অধিনায়ক ঐ ব্যক্তিকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জোর করে তাকে আটক করতে পারে না।
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আশ্রয় প্রদানকারী জাহাজ ও সে দেশের দায়িত্ব হলো আশ্রিত ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান করা। উপরন্তু, বাণিজ্যিক জাহাজেও কোন কোন রাজনৈতিক অপরাধী আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে। কিন্তু, বাণিজ্যিক জাহাজসমূহের উপর স্থানীয় কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার থাকে বিধায় এসব জাহাজ তাদের আশ্রয় অনুমোদন করতে পারে না।
রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে বাংলাদেশিদের পছন্দের দেশগুলো হচ্ছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স, সহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ।
তবে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে এযাবত কালের সব চেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে ২০২৩ সালে। যা ছিলো প্রায় ৪০ হাজার ৩৩২জন । তার মধ্যে অনুমতি মিলেছে মাত্র দুই হাজার জনের। তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আবেদন পড়েছিলো ইতালিতে প্রায় ৫৮ শতাংশ বাংলাদেশি সেখানে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এর পরেই রয়েছে ফ্রান্স। ওই দেশটিতে অনুমতি চেয়েছেন প্রায় ২৫ শতাংশ।
ইইউ-র রাজনৈতিক আশ্রয় বিষয়ক সংস্থা সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করে যে-
যাতে দেখা যায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ আবেদন করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোতে । দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আফগানিস্তান।
২০২২ সালে তুলনায় আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার বেড়ে যাওয়ায় ষষ্ঠ অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের স্থান। সিরিয়া-আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে যুদ্ধ-সংঘাত বিপুল সংখ্যায় আশ্রয় প্রার্থনার একটা বড় কারণ। পৌনে দুই লাখের বেশি সিরিয়ান শরণার্থী ইউরোপে আশ্রয় চেয়েছেন। বেশির ভাগের আবেদনই মঞ্জুর হয়েছে।
আর আফগানদের তরফে আবেদন পড়েছে এক লাখ ১৪ হাজার। ৬০ শতাংশের বেশি গৃহীত হয়েছে।
ইইউএএ-র পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে ৯ হাজার ২৯০ জন বাংলাদেশি ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদন করেন। ওই বছর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল আগের ১৩ হাজারেরও বেশি নথি। ২০২১ সালে আবেদনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৮৩৫ । ২০২২ সালে এই সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার বেড়ে ৩১ হাজার ৯৬৫ হয়। যা ২০২৩ দেখা যায়, ৪০ হাজারের মধ্যে নতুন আবেদনকারী ৩৮ হাজারের ওপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী একটি গণমাধ্যমে বলেছিলেন- “বৈধভাবে অভিবাসনের সুযোগ সীমিত হলেও কিন্তু সে সব দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ফলে, অবৈধ পথে হলেও অনেকেই যেতে চান।”
এর পাশাপাশি তিনি আরও বলছেন, “গত বছর যেহেতু নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের অভ্যন্তরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল, বিরোধী মনোভাবের যারা মনে করেছেন তাদের ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স বা জেলে যাওয়ার ভয় আছে তাদেরও একটা অংশ হয়তো ইউরোপে পাড়ি দিয়ে আশ্রয় চেয়েছেন।