১৩১ বছর আগে ১৭ জন সদস্য নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির পথচলা শুরু। আজ সেই সমিতির সদস্যসংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। দীর্ঘ এ পথচলায় ঐতিহ্যের ছাপ থাকলেও বর্তমানে সমিতির অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন এর সদস্যরা। বেসরকারি ব্যাংকে রাখা ফিক্সড ডিপোজিটের (এফডিআর) বিপুল অর্থ নিয়ে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ।
এফডিআরের মোট টাকার পরিমাণ ৩৩ কোটি ৫৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩২ টাকা। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোতে রয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতার কারণে সাধারণ আইনজীবীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ। তাঁরা দাবি করেছেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এফডিআরের সব টাকা সোনালী ব্যাংকে (কোর্টহিল শাখা) স্থানান্তর করা না হলে বড় ধরনের আন্দোলনে নামবেন।
আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক জানিয়েছেন, বেসরকারি ব্যাংকে থাকা এফডিআরের অর্থ সোনালী ব্যাংকে সরিয়ে আনার বিষয়ে নির্বাহী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে কবে নাগাদ এই স্থানান্তর সম্ভব হবে, তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সমিতির পক্ষ থেকে ৫৪ দফায় বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে এই এফডিআরের টাকা রাখা হয়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত টাকার স্থিতি দাঁড়ায় ৩৩ কোটি ৫৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩২ টাকা।
এর মধ্যে ২৪ কোটি ৭২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩২ টাকা রাখা হয়েছে এবি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের মতো তুলনামূলক সবল ব্যাংকে। কিন্তু আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল, ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ও গ্লোবাল ব্যাংকের মতো দুর্বল ব্যাংকগুলোতে রয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা।
সাধারণ আইনজীবীদের অভিযোগ, বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর করার ক্ষেত্রে সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সদস্যদের মতে, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত তিন সাধারণ সম্পাদকের সময় সবচেয়ে বেশি এফডিআর হয়েছে, যেখানে বিএনপি-সমর্থিত দুই সাধারণ সম্পাদকের সময় এফডিআরের পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম।
আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এ এইচ এম জিয়া উদ্দিন বলেন, “আমার দায়িত্বকালে সব ব্যাংক ভালো অবস্থানে ছিল। নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সদস্যদের লাভের কথা বিবেচনা করেই এফডিআরগুলো করা হয়েছিল।”
অপরদিকে, বিএনপি-সমর্থিত বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক দাবি করেছেন, “আমাদের সময়ে দুর্বল কোনো ব্যাংকে এফডিআর করা হয়নি। সাম্প্রতিক অস্থিরতা সাময়িক, এটি দ্রুত কেটে যাবে।”
২০১৩ সালের ১৯ আগস্ট সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বেসরকারি ব্যাংক থেকে সব এফডিআর তুলে সোনালী ব্যাংকের কোর্টহিল শাখায় স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বরং এর উল্টো পথে হেঁটে দুর্বল ব্যাংকেও এফডিআর করা হয়েছে, যা সাধারণ আইনজীবীদের ক্ষুব্ধ করেছে।
সাবেক সহসম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. মঈনুদ্দিন বলেন, “সোনালী ব্যাংকে এফডিআর করলে আজকের মতো উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। সমিতির সাধারণ সদস্যদের ক্ষোভ যথার্থ।”
আইনজীবী সমিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কোনো সদস্যের মৃত্যুর পর তাঁদের পরিবারকে ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত এককালীন অর্থ সহায়তা দেওয়া। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই চেকও পাস হচ্ছে না।
সাধারণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, “দুর্বল ব্যাংকে এফডিআরের কারণে আমরা ৮ হাজার আইনজীবী উদ্বিগ্ন। দ্রুত এই সংকট সমাধান করা দরকার।”
এফডিআরের অর্থ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা অবশ্য ভিন্ন বার্তা দিচ্ছেন। ইউনিয়ন ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার ম্যানেজার রেজাউল করিম বলেন, “গ্রাহকের এফডিআরের অর্থ নিরাপদ। কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থার সংকট সাময়িক, এটি শিগগিরই কেটে যাবে।”
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি এক সময় ছিল আর্থিক স্থিতিশীলতার প্রতীক। কিন্তু সাম্প্রতিক ব্যাংকিং সংকটের প্রভাব এবং নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্ত আজ এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের সামনে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মেঘ ঘনিয়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এই সংকট নিরসন সম্ভব। তা না হলে ৮ হাজার আইনজীবীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আরও বড় চাপ তৈরি করতে পারে।