বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি প্রকাশিত এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, দেশজুড়ে মূল্যস্ফীতি আন্তর্জাতিক নয় বরং অভ্যন্তরীণ কারণেই ব্যাপকভাবে জেঁকে বসেছে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে হেডলাইন মূল্যস্ফীতির ৫১ শতাংশই এসেছে খাদ্যপণ্য থেকে, যেখানে খাদ্যশস্য ও সবজির দাম বৃদ্ধির কারণ সবচেয়ে বেশি। এর আগে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির জন্য প্রধান কারণ ছিল আমিষ পণ্য, মসলা ও রান্নায় ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় পণ্য।
বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার গত ১৩ বছরে শীর্ষে পৌঁছেছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে গত এক যুগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এ প্রেক্ষিতে, মূল্যস্ফীতির ক্রমাগত বৃদ্ধি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয় কমিয়ে দিচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি উদ্বেগজনক চিত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে, দেশের বাজারে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির জন্য বিশ্লেষকরা নীতি-নির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার বিষয়টিকে দায়ী করেছেন। তারা মনে করছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাগুলো যথেষ্ট নয়। বাজারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব গত প্রান্তিকে কিছুটা কমেছে। এই সময়ের মধ্যে সেবা খাতের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে হেডলাইন মূল্যস্ফীতিতে ২৫ শতাংশ অবদান রাখতে দেখা গেছে, যা জুন মাসে ছিল ১২ শতাংশ।
বিশ্লেষকেরা বারবার বলেছেন, অতীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নকে মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষণ অনুসারে, বর্তমান সরকারের পতনের পর আমদানিনির্ভর পণ্যের অবদান কমে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, স্থানীয় পণ্যের অবদান বেড়ে ৭৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যা অভ্যন্তরীণ সমস্যার চিত্র ফুটিয়ে তোলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষকরা এ বিষয়ে বলেন সাম্প্রতিক বন্যা, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে অসামঞ্জস্য এর জন্য দায়ী। সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমছে, যা বাজারে দামের ওপর প্রভাব ফেলতে অক্ষম হচ্ছে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে পণ্য পৌঁছানোর বিষয়টিও সমস্যা সৃষ্টি করছে।
বর্তমানে, বাজারের পরিস্থিতি উন্নত করতে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজারে নতুন বিক্রেতাদের অন্তর্ভুক্তির পথকে মসৃণ করতে হবে এবং সিন্ডিকেটের প্রভাব কমাতে হবে। তিনি বলেন, “মার্কেট পুলিশিং দিয়ে কোথাও বাজার স্থিতিশীল করা যায় না বরং এতে অস্থিরতা বাড়ে।”
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল এবং চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে পৌঁছেছে। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে অবস্থান করছে, যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার ফলে জনগণের জীবনমান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অবশেষে, দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির পেছনে অভ্যন্তরীণ কারণে সংকটের ব্যাপকতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। বাজারের অব্যবস্থাপনা ও মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে একটি সুষম ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যা দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।