বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, উচ্চ সুদের কারণে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে তারল্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে এবং ঋণের খরচ বাড়ছে। গ্রাহকদের জন্য ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। সরকারও বেড়ে যাওয়া ঋণ খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে- কেন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করছে মানুষ? এর পিছনে কী কারণ? এবং এ পরিস্থিতি কিভাবে দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে?
বিগত কিছু মাসে ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছেন। ২০ শতাংশ বিনিয়োগকারী বর্তমানে সরকারি বিল ও বন্ডে টাকা রাখছেন, যেখানে কয়েক বছর আগে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১ শতাংশের কম। সরকারের ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও সংকুচিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি দেশের মূল্যস্ফীতির দিকে আরও চাপ সৃষ্টি করছে।
এটি ঘটছে দেশের ব্যাংকিং খাতে, যেখানে সরকারের বন্ডে বিনিয়োগের প্রবণতা এখন সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে ঢাকার মতো অর্থনৈতিক হাবগুলোতে এই প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। ব্যাংকগুলো নিয়মিত সরকারি বন্ড ও ট্রেজারি বিল কিনে থাকে, বর্তমানে গ্রাহকদের আমানত টানার ফলে ক্রমশ তারল্য সংকটে পড়ছে।
এ পরিস্থিতি গত কয়েক মাস ধরে বেড়েছে এবং বিশেষ করে চলতি বছরেই এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। ৫ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে তিন বছরের বন্ডে ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ সুদ হার ছাড়াও, এক বছরের ট্রেজারি বিলে সুদ হার ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে গত জুন পর্যন্ত ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বেড়ে ৫ লাখ ৪১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ১০ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়েছে।
এর প্রধান কারণ উচ্চ সুদের হার, যা ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সরকারী বন্ডে বিনিয়োগের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করছে। ট্রেজারি বন্ডের বিনিয়োগে ঝুঁকি নেই এবং সুদের হারও বেশি, যার কারণে মানুষ ব্যাংক আমানত ছেড়ে এসব বন্ডে বিনিয়োগ করছেন। এছাড়া, সঞ্চয়পত্রের তুলনায় সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা অনেক সহজ এবং ঝামেলাহীন।
বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে এসব ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা যাচ্ছে। এতে ট্যাক্স রিটার্ন বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, যা সঞ্চয়পত্রে বাধ্যতামূলক। একই সাথে, এখানে কোনো ঝুঁকি নেই এবং বিনিয়োগকারীরা যেকোনো সময়ে টাকা তুলতে পারেন, তাই মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে।
এ প্রবণতা বাড়ানোর পেছনে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বড় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, যারা তাদের অমীমাংসিত অর্থ সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করছেন। ব্যাংকগুলোর আমানত কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “ব্যাংকের প্রকৃত আমানত কমে যাচ্ছে, কারণ মানুষ টাকা তুলে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করছে।” এর পাশাপাশি, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা জানান, “উচ্চ সুদের হার এবং নিরাপত্তার কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বন্ডে বিনিয়োগ করছেন।”
এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে একদিকে সরকার ও ব্যাংকগুলোকে বড় সুদের ব্যয় সামলাতে হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের জন্য সরকারি বন্ডই হয়ে উঠছে সবচেয়ে নিরাপদ ও লাভজনক পছন্দ।