গত কয়েক বছরে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ওঠা-পড়ার চিত্র দেখে এসেছে। একটি পণ্যের দাম কমাতে গিয়ে আরেকটি পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার দৃশ্য এখন বাজারে অহরহ ঘটছে। করোনার পরবর্তী সময়ে যখন বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে ছিল, তখন বাংলাদেশও ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে ২০২৩ সালের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা, খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি আবারও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকে আলোকপাত করবো।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বর্তমান অবস্থা: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলতে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের অর্থনীতিতে পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণ ও সেবার মান বৃদ্ধিকে বোঝায়। জিডিপি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সূচক । গত এক দশকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ৬.৩ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধিতে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। ২০২১ সালে দেশে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.১%, যা ২০২২ সালে ৬.৯% এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.১২% । তৈরি পোশাক শিল্পে মোট রপ্তানি প্রায় ৮০% দখল করে ২০২২ সালে ৪৩.৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়। যা ২০২৩ সালে ৩৮.৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। তৈরি পোশাক, কৃষি এবং সেবা খাতে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বস্ত্রের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানি আয়ে হ্রাস ঘটেছে। এর পাশাপাশি, খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব বিস্তার করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব: বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও নদী ভাঙনের কারণে দেশের কৃষি খাতের অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০২১ সালে রেকর্ড বৃষ্টির ফলে দেশের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছিল, যা কৃষি খাতের জন্য একটি বড় বিপর্যয়। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদনে ক্ষতি হওয়ায় দেশটির কৃষি খাতের আয় প্রতি বছর আনুমানিক ১০% হ্রাস পাচ্ছে । জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধুমাত্র কৃষিতে খাদ্য উৎপাদনের উপর নয় বরং এটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করছে। সুতরাং, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক: অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা মোকাবেলায় সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। সরকার বর্তমানে ১৪টি সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৩ কোটি মানুষের জন্য সহায়তা প্রদান করছে। ২০২৩ সালের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১.১ শতাংশ জিডিপি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে । তাছাড়া বিভিন্ন ভাতা ও সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে। কিন্তু এগুলোকে আরও কার্যকর করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ- হতদরিদ্র জনগণের জন্য খাদ্য সহায়তা, নগদ সহায়তা এবং স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য জরুরি সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের আওতায় আরও বেশি পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা বাড়ানো উচিত। সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণীর জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে তাদের উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা আবশ্যক।
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ: নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নারীরা ব্যবসা ও শ্রম বাজারে প্রবেশ করলে অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। এ জন্য সরকার এবং বিভিন্ন এনজিও নারীদের প্রশিক্ষণ ও চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করছে। ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শ্রম বাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ৩৮% । এ সংখ্যা ২০১০ ছিল ৩১% , যা সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীদের ক্ষমতায়ন করলে পুরো সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। এ লক্ষ্যে নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে।
বিদেশী বিনিয়োগ: বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য একটি উপযুক্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, সঠিক নীতিমালা এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করা হলে, বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে। সরকারের নতুন শিল্প নীতির আওতায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে। ২০২২ সালে বিদেশী বিনিয়োগের (FDI -Foreign Direct Investment) পরিমাণ ছিল প্রায় ২.৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ সালের অর্থ বৎসরে ৩.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে।
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার: নবায়নযোগ্য শক্তি এমন এক উৎস, যা প্রাকৃতিকভাবেই স্বল্প সময়ে পুনরায় পূরণ হয়ে যায় এবং তা অক্ষয় থাকে। সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈব শক্তি (বায়োমাস), ভূ-তাপ, সমুদ্রের ঢেউ ও তাপ, জোয়ার-ভাটা, শহরের বর্জ্য এবং হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের মতো উৎসগুলো নবায়নযোগ্য শক্তির অন্তর্ভুক্ত। এগুলো আমাদের শক্তির চাহিদা পূরণে সহায়ক হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাবও কম রাখে। অধিকাংশ দেশ আজ বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এই শক্তির উৎসের দিকে মনোনিবেশ করছে। যা টেকসই উন্নয়নের পথকে আরও সুদৃঢ় করতে সাহায্য করবে। নবায়নযোগ্য শক্তি চেজাতীয় ডাটাবেস অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষমতা ১৩৭৪.৬৮ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশ প্রতিদিন গড়ে ৪.৫ বর্গমিটার সৌর বিকিরণ লাভ করে। ২০৪১ সালের মধ্যে মোট ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে । সেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ হাজার মেগাওয়াট।
জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি: টেকসই উন্নয়নের পথে জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওঠা-পড়ার মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি কেবলমাত্র সরকার ও বেসরকারি সংস্থার প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়; বরং এর প্রতিটি স্তরে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। অর্থনীতির ওঠা-পড়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া আরও সহজ ও কার্যকর হতে পারে।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে, আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, তার সমাধান অনেকাংশেই জনগণের সচেতনতার ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণ স্বরূপ- প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার কমানোর জন্য জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার, যাতে তারা দায়িত্বশীলভাবে শক্তি ব্যবহার করে। একইভাবে, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, বর্জ্য পুনঃব্যবহার এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মতো বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করলে দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতি উভয়ের জন্যই তা লাভজনক হবে। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ- বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালু করা, স্থানীয় পর্যায়ে কর্মশালা আয়োজন করা এবং মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রচার করা যেতে পারে। এসব কার্যক্রমে সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করলে তাদের মধ্যে দায়িত্বশীল আচরণ তৈরি হবে এবং তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবেন।
এছাড়াও টেকসই উন্নয়নের পথে জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
সাফল্যের উদাহরণ: বাংলাদেশের কিছু সাফল্যমণ্ডিত উদ্যোগ যেমন: কৃষিতে সংকর জাতের উদ্ভাবন এবং বস্ত্র খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। উদাহরণ স্বরূপ- “কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট” উন্নত জাতের ধান ও সবজির গবেষণা করছে, যা কৃষকের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। এছাড়া, সরকারি উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে ছোট খামারিদের জন্য প্রযুক্তি ও ঋণের সহজ প্রবেশাধিকার সৃষ্টি করা হয়েছে, যা কৃষি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
ভবিষ্যৎ দৃষ্টি: বাংলাদেশকে একটি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদেরকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন এবং জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার ও জনগণের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে পারলে, আমরা একটি টেকসই ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব। বিশেষ করে, সরকারকে টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যা দেশের উন্নয়নকে সঠিক পথে নিয়ে যাবে।
সামগ্রীক ভাবে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ওঠা-পড়া মোকাবেলা করতে হলে আমাদেরকে টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আমাদের সমাজের সব স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এটি আমাদের জাতীয় উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।