বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় সুনামধারী শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অবদান রাখছে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, এই সুনামধারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণতঃ এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে ঋণ পরিশোধের হার অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি থাকার কথা। কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সেই চিত্র পাল্টে গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে ঋণ খেলাপির হার উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এনবিএফআই)। করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব এবং এর পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেমন: ঋণ পরিশোধের সময় পেছানো, তেমনি এর ফলে ঋণের কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, খেলাপি ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেক গ্রাহকই তাদের কিস্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং খেলাপি হচ্ছেন।
এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, পিকে হালদারের মালিকানাধীন ও ব্যবস্থাপনাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণের হার অত্যন্ত বেশি। তার কার্যক্রমে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তা বহু মানুষের জীবনকেও বিপদে ফেলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট যাচাই-বাছাই না করা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, অর্থ পাচার এবং অব্যবস্থাপনার ফলে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে। শুধু এই প্রতিষ্ঠানগুলোতেই নয়, এদের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোরও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেকাংশেই এই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীল। ব্যাংকগুলোর এভাবে ঋণ আদায়ে ব্যর্থতা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমাগত চাপের মুখে ফেলেছে। যা সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরেও প্রভাব বিস্তার করেছে।
খেলাপি ঋণ কেন বাড়ছে?
বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তুলেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে ঋণের সুদহার বাড়াচ্ছে। তবে এই পদক্ষেপের প্রত্যাশিত ফল মূল্যস্ফীতির ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। যদিও সুদের হার বাড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতির অস্থিতিশীলতাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা কিন্তু বাস্তবতা কিছুটা আলাদা। এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ঋণের সুদের চাপ এবং পরিশোধের সমস্যাও বেড়েছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটি উদ্বেগজনক তথ্য সামনে এসেছে, যা আমাদের আর্থিক খাতের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হাল নাগাদ তথ্য অনুযায়ী-চলতি ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এটি বিতরন করা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৫৫ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা বেশি। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এক বছরে এমন একটি বৃদ্ধি আর্থিক খাতের জন্য একটি বড় অশনি সংকেত। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার আরও বেশি ছিল প্রায় ১ লাখ, ৮ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক।
বিশেষজ্ঞদের মতে- ঋণের সুদহার বাড়ানোর সাথে সাথে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। ঋণের সুদের চাপ, মন্দার প্রভাব এবং ব্যাংকগুলোর ঋণ পরিশোধের অনীহা এই বিপর্যয়ের মূল কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ঋণ অনুমোদন করছে, তা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষকরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অনেক সুনামধারী শীর্ষ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রায়ই ঋণ প্রদান করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করেই বড় অংকের ঋণ বিতরণ করছে। রাজনৈতিক প্রভাবে এবং পরস্পর যুগ সাজসের ফলে ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক সক্ষমতার অভাব সত্ত্বেও ঋণ প্রদান করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে খেলাপি ঋণে পরিণতি হয়েছে।
বিশেষ করে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে অনেক ব্যাংক তাদের ঝুঁকি নিরূপণের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করেছে। বড় ব্যবসায়ী কিংবা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য ঋণ প্রক্রিয়া অনেক সময় অতি সহজ হয়ে গেছে। যার ফলে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, কিন্তু পরিশোধের সক্ষমতা না থাকায় তা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এভাবে ঋণ বিতরণের এই অব্যবস্থাপনা ব্যাংকিং খাতে তীব্র অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে এবং এর প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতির উপর পড়েছে। উদাহরণ স্বরূপ- আমরা এস আলম গ্রুপের কথা বলতে পারি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায় যে, নামে-বেনামে ছয়টি ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এই শীর্ষ প্রতিষ্ঠানটি।
খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা অন্যতম একটি বড় সমস্যা। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে ব্যাংকিং আদালতের মামলাগুলোর নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগে। যা ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধে অনীহা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে ঋণ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থায় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এবং আইনগত জটিলতা এই খেলাপি ঋণ সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
সুনামধারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণতঃ লাভ বৃদ্ধি এবং আয় বাড়ানোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। যদিও এ ধরনের বিনিয়োগ উচ্চ আয় প্রদানের সম্ভাবনা রাখে কিন্তু এটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সংকটের মুখে ফেলে। উদাহরণ স্বরূপ- রিয়েল এস্টেট, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উচ্চপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে ঝুঁকি বেশি এবং এসব খাতে অর্থায়ন থেকে প্রাপ্ত ঋণ পরিশোধের হার কম থাকে।
খেলাপি ঋণের আর্থিক প্রভাব:
সুনামধারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের উত্থান আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। প্রথমতঃ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়লে প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজি কমে যায় এবং আয়ের সম্ভাবনা হ্রাস পায়, যা তাদের ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপ সীমিত করে। দ্বিতীয়তঃ এ ধরনের পরিস্থিতি বাজারে আস্থার সংকট তৈরি করে, যা আরও ঋণ প্রদানে সমস্যা সৃষ্টি করে। খেলাপি ঋণের হার বাড়লে প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করে এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়।
সংকট সমাধানের পদক্ষেপ:
প্রতিটি ঋণ প্রদানের আগে ঋণগ্রহীতার আর্থিক সক্ষমতা এবং প্রকল্পের ঝুঁকি নিরূপণের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া প্রণয়ন করা উচিত। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী মূল্যায়ন কাঠামো অনুসরণ করতে হবে। যাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ কমে যায় এবং পরবর্তী সময়ে খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হলো নৈতিক অবক্ষয় রোদ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকি ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করার মাধ্যমে খেলাপি ঋণের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। নিয়মিত অডিট এবং খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের নিয়মকানুন অনুসরণ করা গেলে আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে।
খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থায় আইনগত সংস্কার আনা জরুরি। বিশেষতঃ ঋণ পুনরুদ্ধার ও নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় বিলম্ব দূর করতে ঋণ পুনরুদ্ধার ট্রাইব্যুনাল ও দ্রুততম বিচার ব্যবস্থা প্রয়োগ করা উচিত। এ ধরনের ব্যবস্থা ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধে দায়িত্বশীলতা আরো বৃদ্ধি করবে।
সুনামধারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ঝুঁকিপূর্ণ খাতে অতিরিক্ত ঋণ বিতরণের সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করা। উচ্চ ঝুঁকির খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র দক্ষ ও অভিজ্ঞ ঋণ ব্যবস্থাপকদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা উচিত। এই খাতে বিনিয়োগ সীমিত থাকলে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সহজ হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে এনে ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতাদের সহায়তা করতে পারবে। পুনর্গঠনের ফলে ঋণগ্রহীতারা তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত সময় পাবেন, যা আর্থিক অবস্থার উন্নতিতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সুনামধারী শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার ঘাটতি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ নীতির কারণে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এই সংকট সমাধানে দায়িত্বশীল তদারকি, নিরপেক্ষ যাচাই-বাছাই, ঋণ অনুমোদনের কড়াকড়ি এবং আইনগত সংস্কার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্রিয় ভূমিকা এবং ঋণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আস্থা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে। এভাবে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আবারও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিত্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরো সুদৃঢ় করবে।