অর্থনীতি একটি দেশের মেরুদণ্ড, আর সেই অর্থনীতিকে সচল রাখে দেশের সাধারণ মানুষ। কৃষক থেকে পোশাক শ্রমিক, দিনমজুর থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা—সকলেই মিলে গড়ে তোলেন একটি দেশের উৎপাদন, আয় ও ভোগব্যবস্থা। অথচ যারা এই চাকা ঘোরানোর মূল চালিকাশক্তি,সেই সাধারণ মানুষের কণ্ঠ কতটা প্রতিফলিত হয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে? সিদ্ধান্তগুলো কি তাদের কথা মাথায় রেখে নেওয়া হয়, নাকি কিছু সংখ্যক নীতিনির্ধারকের বোর্ডরুমে বসেই পরিসংখ্যান আর প্রক্ষেপণের ভিত্তিতে তৈরি হয় জাতীয় পরিকল্পনা?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী। বৈদেশিক ঋণের বোঝা, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, আয়ের বৈষম্য, রিজার্ভ সংকট এবং আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা একসাথে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে নাড়া দিচ্ছে। এসব সংকট মোকাবেলায় সরকার একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কখনো কর কাঠামোতে রদবদল, কখনো ভর্তুকি প্রত্যাহার বা কখনো বৈদেশিক ঋণে নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা, মতামত বা অংশগ্রহণ কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত। বাজেট প্রণয়ন, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ কিংবা মুদ্রানীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয় সরকারের উচ্চপর্যায়ের কিছু সংস্থা ও পরামর্শদাতা মহলের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, শ্রমজীবী মানুষ কিংবা কৃষকের মতামত, বাস্তবতা কিংবা চাহিদা খুব কমই গুরুত্ব পায়। অথচ দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারাই সবচেয়ে বেশি খেটে খাওয়া ও ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষ।
সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় ‘জনগণ’ মানে কী?
যখন কোনো অর্থনৈতিক বা উন্নয়নমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন সেই সিদ্ধান্তের প্রভাব কাদের ওপর পড়বে—এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় ‘জনগণ’ বলতে বোঝায় সেই সব মানুষকে, যাদের জীবন, পেশা, আয় বা সুযোগ-সুবিধার উপর সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে ওই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে। সুতরাং তাদের অভিজ্ঞতা, মতামত ও প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করাই গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার মূল কথা।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণের অংশগ্রহণের অর্থ কেবল নির্বাচন করে প্রতিনিধি পাঠানো নয় বরং নীতিনির্ধারণে সাধারণ মানুষের চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশাকে অন্তর্ভুক্ত করা। অর্থনৈতিক নীতি, বাজেট প্রণয়ন বা বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া, তাদের বাস্তব চাহিদা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা—এটাই হওয়া উচিত গণমুখী ও অংশগ্রহণমূলক নীতিনির্ধারণ।
ধরা যাক একটি শহরে নতুন রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তে কেবল প্রকৌশলী বা ঠিকাদারদের মত নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামত, ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন এবং যানবাহন ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারাই প্রতিদিনের বাস্তবতায় জানেন কী সমস্যা রয়েছে এবং কীভাবে সেটি সমাধান করা যেতে পারে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই অংশগ্রহণ এখনো অনেক সীমিত। বাজেট ঘোষণার আগে সরকার প্রাক-বাজেট আলোচনার আয়োজন করলেও, সেখানে সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধি খুব একটা দেখা যায় না। আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে কিছু ব্যবসায়ী সংগঠন, চেম্বার, অথবা পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। একদিকে যখন কর কাঠামো বদলানো হয়, ভর্তুকি কমানো হয়, কিংবা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া হয়—অন্যদিকে সেই সিদ্ধান্তের প্রভাব যাদের জীবনকে সরাসরি নাড়া দেয় যেমন: রিকশাচালক, গার্মেন্ট শ্রমিক, দিনমজুর, কিংবা গ্রামের কৃষক—তাদের মতামতের কোনো প্রতিফলনই সেই সিদ্ধান্তে থাকে না।
আজকের বৈষম্যমূলক ও অসম ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় যে ঘাটতিটি চোখে পড়ে তা হলো—নীতিনির্ধারণের কক্ষে সাধারণ মানুষের অনুপস্থিতি। এই বাস্তবতা বদলানো জরুরি। কারণ অংশগ্রহণ ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না। সিদ্ধান্ত তখনই যথাযথ হয়, যখন তা প্রভাবিত মানুষের কথা মাথায় রেখে নেওয়া হয়।
কেন দরকার জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ?
অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্যই হওয়া উচিত জনগণের জীবনমান উন্নয়ন। অথচ বাস্তবতা হলো অনেক সময়েই যাদের জন্য এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তাদের বাস্তব জীবন, প্রয়োজন কিংবা সমস্যা না জেনেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ফলে সেই সিদ্ধান্তগুলো কাগজে কলমে হয়তো যথাযথ মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে গিয়ে তা অনেক সময় কার্যকর হয় না—বরং কখনো কখনো পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।
যেমন: যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে—চাল, ডাল, তেল কিংবা সবজি—তখন বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা নীতিমালা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সেই নীতিতে বেশি গুরুত্ব পায় ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীদের মতামত। অথচ একজন দিনমজুর বা প্রান্তিক পরিবারের মা যখন বাজারে গিয়ে দাম শুনে পণ্যের অর্ধেক কিনে ফিরে আসেন—সেই বাস্তবতা কি আদৌ নীতিনির্ধারণের কক্ষে পৌঁছায়? তারা যেন এই প্রক্রিয়ায় একেবারেই অদৃশ্য।
বাংলাদেশের মতো দেশে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে ভোটের সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে তাদের অস্তিত্ব প্রায় অনুপস্থিত। শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, এই সমস্যা কাঠামোগতও। কারণ অর্থনীতির বিষয়গুলো সাধারণের বোধগম্য করে তোলার উদ্যোগ খুব কম নেওয়া হয়। বাজেট, মুদ্রানীতি, বা ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত—এসব সাধারণ মানুষের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলছে, তা বোঝানোর চেষ্টা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ সময় এই সিদ্ধান্তগুলো এমন ভাষায় উপস্থাপন করা হয় যা শহুরে শিক্ষিত গোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের বোধগম্য হয় না।
প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার আগে ঘটা করে “প্রাক-বাজেট আলোচনার” আয়োজন হয়। কিন্তু সেই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে ঢাকার কনফারেন্স রুমে, কিছু ব্যবসায়ী, করদাতা সংগঠন ও পেশাজীবীদের মাঝে। একজন কৃষক, গার্মেন্ট শ্রমিক, কিংবা রিকশাচালকের জীবনের খরচ, আয় কিংবা চাহিদা—এই আলোচনায় ঠাঁই পায় না। অথচ তারাই তো দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, যাদের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করাই হওয়া উচিত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের মুখ্য উদ্দেশ্য।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে “জনগণের অংশগ্রহণ” বলতে কেবল ভোট নয়—বরং তাদের অভিজ্ঞতা, দরকার ও কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত হওয়াই হচ্ছে প্রকৃত অংশগ্রহণ। আর এটি নিশ্চিত করতে হলে দরকার স্বচ্ছতা, সহজ তথ্যপ্রবাহ, স্থানীয় পর্যায়ে মতামত নেওয়ার বাস্তব ব্যবস্থা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনার সংস্কৃতি।
মহামারি ও মূল্যবৃদ্ধি: জনগণের চাহিদা উপেক্ষিত কেন? করোনা মহামারি আমাদের দেখিয়েছে নীতিনির্ধারকরা যখন জনগণের বাস্তবতা না জেনে শুধুমাত্র কাগজে-কলমে সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার প্রভাব কতটা নেতিবাচক হতে পারে। মহামারির সময় বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন দেওয়া হলেও সেই লকডাউনকৃত অঞ্চলের মানুষের প্রকৃত চাহিদা কেমন ছিল, কীভাবে তারা খাবার বা চিকিৎসা পাবে—এসব বিষয় আগেভাগে ভেবে দেখা হয়নি। ফলে বহু মানুষ ত্রাণের অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে বাধ্য হয়েছে।
এমনকি সরকারিভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো হলেও, তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। যদি সেসময় জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা সুশীল সমাজের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে পরিকল্পনা করা হতো, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। চাল, ডাল, তেল, ডিম, মুরগি, সবজি থেকে শুরু করে শিশুখাদ্য পর্যন্ত—প্রায় সবকিছুর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ এই বাস্তবতায় সরকার কিছু খাতে ভর্তুকি কমিয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। একইসঙ্গে করনীতিতেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার ফলে আমদানিকৃত অনেক পণ্যের ওপর কর বেড়েছে। এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার বাস্তব চিত্র ও আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য তেমনভাবে বিবেচনায় আনা হয়নি।
এগুলো মূলত কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কিছু পরিসংখ্যান ও আর্থিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে নেওয়া সিদ্ধান্ত, যেখানে সাধারণ মানুষের মতামত বা অভিজ্ঞতার প্রতিফলন খুবই সীমিত। ফলে এইসব নীতির সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়েছে সেই সব মানুষদের ওপর যারা এমনিতেই মুদ্রাস্ফীতি, আয় কমে যাওয়া এবং কর্মসংস্থানের সংকটে জর্জরিত। অনেক পরিবার এখন দিনে তিনবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা হারাচ্ছে। এতে শুধু আর্থিক দুরবস্থাই নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার উপরও চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ ও বাংলাদেশের সম্ভাব্য পথ:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নানা ধরনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর অন্যতম সফল উদাহরণ ব্রাজিলের “পার্টিসিপেটরি বাজেটিং” ব্যবস্থা। ১৯৮৯ সালে পোর্তো আলেগ্রে শহরে শুরু হওয়া এই পদ্ধতিতে স্থানীয় জনগণ সরাসরি মত দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তাদের এলাকার কোন খাতে কী পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ হবে। এটি শুধু স্বচ্ছতা বাড়ায়নি বরং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়নকে বাস্তব রূপ দিয়েছে।
ভারতের কেরালা রাজ্যেও দীর্ঘদিন ধরে “জনভিত্তিক পরিকল্পনা” (People’s Plan Campaign) কার্যকরভাবে চালু আছে। সেখানে গ্রাম ও নগর পর্যায়ের মানুষ সরাসরি অংশ নেন উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। এর ফলে স্থানীয় জনগণের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ হয় এবং সরকারের ওপর জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদিও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এখনো খুব সীমিত। বাজেট প্রণয়নের আগে যে ক’টি প্রাক-বাজেট আলোচনা হয়, তা মূলতঃ কেন্দ্রীয় শহরভিত্তিক এবং কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ইউনিয়ন, পৌরসভা কিংবা ওয়ার্ড পর্যায়ে বাজেট নিয়ে জনগণের মতামত নেওয়ার কোনো কার্যকর ও নিয়মিত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
তবে সম্ভাবনা একেবারে নেই, তা নয়। নাগরিক সমাজ, স্থানীয় সরকার এবং কিছু এনজিও পর্যায়ে সম্প্রতি অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনার কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নাগরিক মতামত নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে। তবে তা এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশ যদি ব্রাজিল ও কেরালার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কাঠামোগত সংস্কার করতে পারে তাহলে তা হতে পারে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং জনকল্যাণ নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ পথ। এতে সরকারের সিদ্ধান্ত আরও গ্রহণযোগ্য হবে এবং উন্নয়নের ফলাফল আরও টেকসই হবে।
জনঅংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা: বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় জনগণের অংশগ্রহণ এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কাঠামোগত ও বাস্তবিক বাঁধা, যা দীর্ঘদিন ধরেই এই অংশগ্রহণকে সীমিত করে রেখেছে।
প্রথমত: সচেতনতার অভাব একটি বড় বাঁধা। এখনো অনেকের মাঝেই এই বিশ্বাস প্রচলিত যে—অর্থনীতি বা বাজেট শুধুই বিশেষজ্ঞ বা সরকারের বিষয়। ফলে সাধারণ মানুষ নিজের জীবনের সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতির যোগসূত্র বুঝতে পারে না। বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত তাদের জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে, সে সম্পর্কে সচেতন নয়। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমেও নাগরিক দায়িত্ব ও বাজেট প্রক্রিয়া সম্পর্কে তেমন কোনো স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয় না।
দ্বিতীয়ত: অধিকতর কেন্দ্রীভবন নীতিগত অংশগ্রহণের বড় অন্তরায়। দেশের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যেমন: বাজেট, করনীতি, ভর্তুকি ইত্যাদি—ঢাকাকেন্দ্রিক উচ্চপর্যায়ের কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ইউনিয়ন, পৌরসভা বা জেলা পর্যায়ের বাস্তব চাহিদা বা মতামত পরোক্ষভাবেই ধামাচাপা পড়ে যায়।
তৃতীয়ত: রাজনৈতিক প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই জনমতের চেয়ে বেশি কার্যকর হয়ে ওঠে। কোনো কোনো সময় সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের মত নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের সময় রাজনৈতিক পক্ষপাত, ক্ষমতার ভারসাম্য কিংবা দলীয় সুবিধাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে মানুষের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভবিষ্যতে অংশগ্রহণে অনাগ্রহ জন্মায়।
চতুর্থত: প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এখনও বড় বাস্তবতা। সরকার ডিজিটাল মাধ্যমে যেমন: ওয়েবসাইট, অ্যাপ, হেল্পলাইনের মাধ্যমে নাগরিক মতামত নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও দেশের অধিকাংশ গ্রামের মানুষ এখনো নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট কিংবা স্মার্টফোন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তথ্যপ্রযুক্তির অভাব এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার ঘাটতির কারণে তারা এসব প্ল্যাটফর্মে অংশ নিতে পারে না।
এছাড়া ভাষাগত জটিলতা, তথ্যের জটিল উপস্থাপন এবং প্রান্তিক জনগণের মধ্যে “আমার মত নিলে কী হবে”- ধরনের হতাশাবোধও এক ধরনের অদৃশ্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এই সব সীমাবদ্ধতা দূর করতে হলে একদিকে যেমন নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা প্রয়োজন, অন্যদিকে দরকার শিক্ষা, গণমাধ্যম এবং স্থানীয় সরকারকে আরও কার্যকরভাবে যুক্ত করা।
সমাধানের পথ: জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কী করা যেতে পারে? অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণকে বাস্তব রূপ দিতে হলে শুধু সদিচ্ছা নয়, প্রয়োজন সুপরিকল্পিত ও কাঠামোগত উদ্যোগ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু সম্ভাব্য করণীয় নিম্নরূপ-
প্রথমত: গ্রাম ও শহর পর্যায়ে জনসংলাপের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে বাজেট শুনানি, মতবিনিময় সভা বা নাগরিক সংলাপ আয়োজনের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এতে স্থানীয় মানুষ সরাসরি বলতে পারবেন—তাদের চাহিদা কোথায়, কোন খাতে বরাদ্দ প্রয়োজন বেশি। এমন প্রক্রিয়া ভারতের কেরালায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সফলভাবে চলছে।
দ্বিতীয়ত: সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের নাগরিক বাজেট বা জনগণের আর্থিক অধিকারের বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে। গণমাধ্যম নিয়মিতভাবে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক নীতির বিশ্লেষণ প্রচার করতে পারে সাধারণ মানুষের ভাষায়। এতে জনগণ তথ্যভিত্তিক মতামত দিতে উৎসাহিত হবে।
তৃতীয়ত: “Participatory Budgeting” ব্যবস্থাকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট কিছু পৌরসভা বা ওয়ার্ডে এটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন করে দেখা যেতে পারে—কীভাবে জনগণ সরাসরি ভোট বা মতামতের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে অংশ নিতে পারে। ব্রাজিলের মতো দেশে এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে সফলভাবে চলছে।
চতুর্থত: সহজ ও সর্বজনগ্রাহ্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা দরকার, যেখানে সাধারণ মানুষ সরাসরি মতামত দিতে পারবেন। এটি হতে পারে মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইট—যেখানে বাজেটের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে সহজ ভাষায় এবং মানুষ তা নিয়ে মতামত দিতে পারবে। তবে এর জন্য ইন্টারনেট অ্যাকসেস নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
পঞ্চমত: স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং বাজেট বাস্তবায়নে জনগণের নজরদারি নিশ্চিত করাও অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতির অংশ। বাজেট শুধু ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, তার প্রতিটি স্তরে জনগণের উপস্থিতি ও মতামত থাকলে সেটি আরও কার্যকর হয়।
পরিশেষে বলা যায় একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি আর বিলাসিতা নয়—এটি একটি প্রয়োজন। এটি শুধু ন্যায়ের ভিত্তি তৈরি করে না বরং সিদ্ধান্তগুলোকে আরও কার্যকর ও টেকসই করে তোলে।
অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জনগণের অংশগ্রহণ কেবল একটি নৈতিক বা গণতান্ত্রিক দাবি নয়, এটি একটি বাস্তব প্রয়োজন। জনগণই অর্থনীতির কেন্দ্রে—তাদের আয়, ব্যয়, সংকট ও চাহিদার ওপরই নির্ভর করে অর্থনীতির গতিপথ। অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে অর্থনৈতিক নীতিমালা গঠনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সীমিত ও প্রতীকী। বাজেট, করনীতি কিংবা ভর্তুকির সিদ্ধান্তে প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা প্রায়ই অনুপস্থিত। এর ফলে একদিকে যেমন নীতিমালার কার্যকারিতা কমে যায়, অন্যদিকে জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণের মনোভাব দুর্বল হয়। এই বাস্তবতা পাল্টাতে হলে দরকার সুসংহত কাঠামো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের প্রতি সম্মান। অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলাই হতে পারে টেকসই, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের পথ।