বাংলাদেশ এখন ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে। সরকারি হিসাবে বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ ইলিশই আসে এই দেশ থেকে। তবে বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। বাজারে ইলিশের দাম এতটাই বেশি যে মধ্যবিত্ত তো দূরের কথা, অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারও মাছটি কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ প্রতিবছরই সরকার বলছে—ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে।
জেলে ও আড়তদারদের অভিযোগ, জেলা থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত মৎস্য বিভাগের দেওয়া হিসাব আসলে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। তাদের দাবি, মাঠপর্যায় থেকে কেউই প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর প্রতিবছর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ, অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন ও পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রবণতা দেখানো হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ সাল থেকে দেশে প্রতিবছরই ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।
কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রতিফলন নেই। অনেক ঘাটেই ইলিশ কমছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। দামে অসহনীয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ মাছটি আর সহজে কিনতে পারছে না। এর পেছনে ভুল বা অনুমাননির্ভর পরিসংখ্যানকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত জুনের শেষ সপ্তাহে লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন মাছঘাট পরিদর্শন করে। সরেজমিনে কথা বলে অন্তত ৫০ জন জেলে, আড়তদার ও মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে। সবার অভিযোগ একই—ইলিশ উৎপাদনের সরকারি হিসাব বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলায় ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার টন। কীভাবে এই হিসাব তৈরি হয়—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জেলার মেঘনা নদী-সংলগ্ন ২৫টি মাছঘাটের মধ্যে বড় ১২টিতে ১২ জন গণনাকারী আছেন। তারা প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিসে মাছের পরিমাণ জানান, সেখান থেকেই হিসাব তৈরি হয়।” তবে ঘাটের বাস্তবতা তার চেয়ে একেবারেই আলাদা।
লক্ষ্মীপুরের বিখ্যাত মতিরহাট মাছঘাটে রয়েছে ৪২টি আড়ত। এখানকার আড়তদার মো. আমজাদ হোসেন (৪০) বলেন, “আমি ১৫ বছর ধরে আড়ত চালাই। এখানে কখনো মৎস্য বিভাগের কাউকে গণনার কাজে দেখিনি। এমন কথা হাস্যকর।” এমন মন্তব্য করেন মারুফ ও জয়নাল নামের দুই আড়তদারও। তাদের ভাষ্য, “এখানে ইলিশ ওজনে বিক্রি হয় না, হয় হালি বা পিস হিসেবে। আর মৎস্য বিভাগ কখনো মাঠে এসে তথ্য নেয় না।”
মাছ ব্যবসায়ী মো. আপেল মিয়া (৪৩) বলেন, “আমি দেশের বিভিন্ন ঘাট থেকে ইলিশ কিনে সরবরাহ করি। কিন্তু প্রতি বছর উৎপাদন বাড়ার যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়, তা পুরোপুরি মনগড়া মনে হয়। হয়তো কোনো প্রকল্পের শর্ত পূরণের জন্য এমন প্রবণতা দেখানো হয়।” তিনি আরও বলেন, “যদি আমাদের জেলার হিসাব মিথ্যা হয়, তাহলে জাতীয় পরিসংখ্যানও প্রশ্নবিদ্ধ।”
রামগতির আলেকজান্ডার খাল ঘাটের আড়তদার রফিক জানান, “এখানে ৫২টি আড়ত রয়েছে। কিন্তু কখনো কেউ এসে মাছের হিসাব নেয়নি।” তার ভাষায়, “এখানে ইলিশ বিক্রি হয় হালি ধরে, কোনো অফিসিয়াল রেকর্ড নেই।” টাংকিবাজার ঘাটের আড়তদার পলাশ বলেন, “এখানে ইলিশ বিক্রি হয় ‘পণ’ হিসেবে—মানে ৮০ পিসে এক পণ। কিন্তু কে কী পরিমাণ মাছ আনছে বা বিক্রি করছে, তা কেউ জানতে আসে না।”
জেলে জলিল আহম্মদ (৬০) বলেন, “সরকার হয়তো বড় শহরের বাজারে ইলিশের ওজন ধরে হিসাব করছে। কিন্তু সব মাছ তো মোকামে আসে না। প্রকৃত হিসাব করতে হলে ঘাট থেকেই তথ্য নিতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “প্রতিবছরই বলা হয় উৎপাদন বাড়ছে। অথচ নদীতে আমরা মাছ পাই না। ইলিশ এখন জেলের হাত থেকেও দূরে।”
ফরহাদ ইসলাম বলেন, “উৎপাদন বাড়ার খবর পাই সংবাদে। কিন্তু নদীতে মাছ নেই, বাজারে দাম আকাশছোঁয়া। এর মূল কারণ ভুল পরিসংখ্যান্লা জেলা মৎস্য অফিস বলছে, লক্ষ্মীপুরে বছরে ২৩ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন ৮২ টন, অর্থাৎ ২৫টি ঘাট থেকে প্রতিটিতে গড়ে সাড়ে তিন হাজার কেজি ইলিশ উঠেছে। কিন্তু ঘাটের জেলে ও আড়তদারদের মতে, সব মিলিয়ে দৈনিক ২০ টন ইলিশও ওঠে না। এই ব্যবধান থেকেই তৈরি হচ্ছে প্রশ্ন—সরকারি পরিসংখ্যান কতটা নির্ভরযোগ্য?