বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ডলারের দর উচ্চমূল্যেই স্থির থাকায় ব্যবসায়ীরা লেনদেনে সতর্ক। রপ্তানিতেও প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে দুই দিনের মধ্যে বাড়তি শুল্ক কার্যকর হবে। অন্যদিকে, ভারতে পণ্য রপ্তানিতে রয়েছে নানা বিধিনিষেধ।
শিল্প খাতের জন্য জ্বালানি পরিস্থিতি আরও কঠিন। গ্যাসের দাম বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ, তবুও সরবরাহ সঠিকভাবে নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) খরচ কমানোর চাপ দিচ্ছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, যদি সংস্থার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হয়, তা পুরো শিল্প খাতের জন্য ধস নামাবে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, “একটি দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিতে হলে শিল্প উৎপাদন বাড়াতে হবে। শিল্প উৎপাদন বাড়াতে হলে কম দামে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে শিল্পে যে দামে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে, তা অনেক দেশের চেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম কমানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। দাম বাড়ানো ঠিক হবে না।”
চট্টগ্রামের আরডিএম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিজিএমইএর পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী জানান, “সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর তোড়জোড় করছে। বছর দুয়েক আগে দাম একবার বাড়ানো হয়েছিল। আমরা যেসব দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করি—ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া—তাদের সঙ্গে টিকে থাকতে গ্যাসের দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। আমরা ডলার, পাউন্ড, সেন্ট অনুযায়ী প্রতিযোগিতা করি। এক-দুই সেন্টের পার্থক্যও বড় প্রভাব ফেলে। ভারত ও চীনের মতো প্রতিযোগী দেশে গ্যাসের দাম অনেক কম। সেখানে আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বেগ লাগছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে পোশাকশিল্পে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে হাজারো শ্রমিক বেকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই সরকারের উচিত সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।”
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চলতি বছরের এপ্রিল মাসে নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। শিল্প গ্রাহকদের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। ক্যাপটিভ শিল্পে দাম ৩১ টাকা থেকে ৪২ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এতে প্রতি ইউনিটের জন্য ১০ টাকা বাড়তি খরচ পড়ছে।
তৈরি পোশাকশিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ও রাইজিং ফ্যাশনস লিমিটেডের এমডি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “ধাপে ধাপে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার পূর্বে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়ে দাম ১৫০ থেকে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছিল। একই কথা বলে গত বছরও দাম বাড়ানো হয়েছিল। এপ্রিলেও একইভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু দুই বছর পরও শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি। এখনো নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে আমরা ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দামে গ্যাস কিনছি।”
ব্যবসায়ী নেতারা গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, “বর্তমানে গ্যাসের যে দাম আছে তা কমাতে হবে। যদি সরকার জ্বালানি খাতে খরচ কমানোর নাম করে দাম বাড়ায়, তবে শিল্প খাতে ধস নামবে। অনেক শিল্প টিকে থাকতে পারবে না। এ পরিস্থিতি পুরো অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
বর্তমানে দেশে দৈনিক অনুমোদিত গ্যাসের লোড ৫৩৫ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে চাহিদা ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ মাত্র ২৮০ থেকে ৩০০ কোটি ঘনফুট। ফলে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমন অবস্থায় দাম না বাড়িয়ে ঘাটতি কাটানোর পথ খুঁজে বের করতে হবে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের এমডি এ কে আজাদ বলেন, “আমি এর আগেও বলেছি, গ্যাস সরবরাহে সিস্টেম লসের নামে ১০ শতাংশ চুরি হয়। এটি বন্ধ করলে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারই এটি করতে পারে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতের অবস্থা ভালো নেই। তাই সময়ের দাবি হলো বর্তমান দামে গ্যাস রাখা। কোনো অবস্থাতেই দাম বাড়ানো ঠিক হবে না।”
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ও ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তাসকীন আহমেদ বলেন, “গ্যাসের দাম বাড়ালে শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এতে পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা কমবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো বিশেষভাবে চাপে পড়বে। মূল্যে বৃদ্ধি না করে সমন্বয় করা অতি জরুরি। জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা বাড়ানো, বিকল্প জ্বালানির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও নীতিগত সহায়তা দ্রুত করা জরুরি। এতে শিল্প উৎপাদন ও বিনিয়োগ ধারাবাহিক থাকবে, কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”
দেশে বিনিয়োগ কমেছে। নতুন শিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে না, পুরোনো শিল্পেও গতি কম। গত আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬.৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। জুলাইয়ে হার ছিল ৬.৫২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে এলসি খোলা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে, তবে নিষ্পত্তি কমেছে ১১.৮৭ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা কমেছে ১১.৬২ শতাংশ এবং এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ৯.৭২ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ সুদের হার এবং অনিশ্চয়তার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আরও জানিয়েছেন, ব্যবসায় অনিশ্চয়তা কমাতে খরচ কমাতে হবে। তার অন্যতম উপায় হলো শিল্প খাতের জন্য গ্যাসের দাম কমানো।

