বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশের পথে হাঁটলেও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বহিঃসংস্থার ঋণের ভার ক্রমেই বেড়ে চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য ৪.১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের চাপ বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে এক সংকটপূর্ণ ক্রান্তিকালের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এই বিশাল ঋণ পরিশোধের চাপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর স্থায়িত্বের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
ক্ষমতাচ্যুত বিগত সরকার গত ১৫ বছরে যে বিশাল অঙ্কের বিদেশি ঋণ নিয়েছে, তা দেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপাকে ফেলেছে। ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তবে এসব ঋণের বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে দর-কষাকষি করে ও বাছবিচারহীনভাবে, যার ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতিতে ঋণের বোঝার চাপ বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে ৩.৩৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে সুদ-আসল মিলিয়ে পরিশোধ করতে হবে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়াবে ৫.২ বিলিয়ন ডলার।
বিশাল অঙ্কের ঋণ নেওয়ার কারণে সুদ ও আসল পরিশোধের চাপ এখন বর্তমান সরকারের ঘাড়ে। দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে সুদের হারও অনেক বেড়েছে। তবে নতুন সরকার দায়িত্বে আশার পর বিদেশি ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার আশ্বাস দিয়েছে। ঋণ নেওয়ার সময় সুদের হার, কিস্তি, পরিশোধের মেয়াদসহ বিভিন্ন শর্ত যাচাই-বাছাই করে যদি নতুন সরকার ঋণ নেয় তবে আশা করা যায় বাংলাদেশের নতুন করে কোন সংকটে পড়তে হবেনা।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম বছর থেকেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান ভিত্তি হিসেবে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চালু রাখতে এবং দেশের অবকাঠামো শক্তিশালী করতে এই ঋণগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ঋণের বোঝা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধ একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, যার একটি বিশাল অংশই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এবং বিভিন্ন উন্নত দেশ থেকে নেওয়া। এর মধ্যে ৪.১৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের চাপ বাংলাদেশকে ২০২৪- ২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে মোকাবিলা করতে হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ আসল ও সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের পরিশোধ করেছিল ২৬৭ কোটি ডলার। এরমধ্যে আসল পরিশোধ করেছিল ১৭৩ কোটি ডলার। আর সুদ পরিশোধ করেছিল প্রায় ৯৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫শ ৬৩ কোটি ডলার ঋণ করেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে আসল ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ২০১ কোটি এবং ১৩৫ কোটি ডলার। আর সদ্য চালু হওয়া ২০২৪- ২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশকে প্রায় ৪.১৮ বিলিয়ন ডলারের মতো পরিশোধ করতে হবে যার বেশিরভাগই জাপানের কাছ থেকে নেয়া ঋণ। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি এবং বৈশ্বিক মন্দার প্রেক্ষাপটে এই ঋণ পরিশোধের কাজটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে।
গত অর্থবছরে (২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালে মার্চ পর্যন্ত )বাংলাদেশ ৫শ ৬৩ কোটি ডলার ঋণ করেছে। আবার আগে নেওয়ার ঋণসহ বর্তমান অর্থবছরে পরিশোধযোগ্য কোটি ডলার ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। সদ্য প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত এক মাসে ৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার ডলার কমে ২ হাজার ৪৬৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার বা ২৪ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের দাঁড়িয়েছে । এই রিজার্ভ ঋণ পরিশোধে ব্যয় করা হলে আমদানি পণ্য ক্রয়ের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দিতে পারে। এর ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
দ্বিতীয়ত, রপ্তানি আয়ে স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতেও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়ায় ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সেখানে রপ্তানি আয় কমছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনেও বিভিন্ন বাধা দেখা দিয়েছে, যা রপ্তানি আয়কে প্রভাবিত করছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য যে মুদ্রার প্রয়োজন, তা অর্জন করা কঠিন হচ্ছে। ফলে রিজার্ভ বৃদ্ধি করে মুদ্রা সংকট দূর করে ঋণ শোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, দেশে রিজার্ভ আয় বৃদ্ধির জন্য প্রবাসী আয়ের উপর নির্ভরতা বাড়লেও সেই আয় যথেষ্ট নয়। বৈদেশিক কর্মীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হতে পারছে না। এর ফলে ঋণ পরিশোধে অভ্যন্তরীণ তহবিল বা প্রবাসী আয়ের উপর নির্ভর করা দুরূহ হয়ে উঠেছে।
ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক সুনাম হারাতে পারে। এমনকি এক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ঋণ খেলাপি তকমাও অর্জন করতে পারে। যদি বাংলাদেশ সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তাহলে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা দেশের উপর আস্থা হারাতে পারে, যা ভবিষ্যতে বিদেশি ঋণ এবং বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত করে দেবে।
দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নের অভাব দেখা দিতে পারে। যেহেতু বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অর্থ ব্যয় হবে, ফলে দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ কমতে পারে। এতে বাজেটের কাটছাঁট করার কারণে শিক্ষাখাত, স্বাস্থ্যখাত, এবং অন্যান্য সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন সংকুচিত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বাঁধা সৃষ্টি করবে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের ব্যাপক ঋণ পরিশোধের ফলে দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে, কারণ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে মুদ্রা ছাপাতে হতে পারে বা নতুন ঋণ নিতে হতে পারে। যা অর্থনীতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টাকার মান দুর্বল হতে পারে, যা আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি করবে এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া, ঋণের চাপে সরকারি সেবা ও অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ কমে গেলে দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে, যা কর্মসংস্থানের ওপরও প্রভাব ফেলবে।
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের জন্য কিছু কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। প্রথমত, দেশের রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। এর জন্য নতুন বাজার খুঁজে বের করে এবং রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে হবে, যাতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক ছাড়াও, ওষুধ, চামড়া এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়ানো যেতে পারে। রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য এনে এবং ক্রেতা দেশগুলোতেও বৈচিত্র্য এনে এই রপ্তানি হার বাড়িয়ে রিজার্ভ বাড়ানো যায়।এতে বৈদেশিক ঋণ শোধ সহজ হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষত, প্রবাসী কর্মীদের জন্য আরও আকর্ষণীয় ব্যাংকিং সুবিধা এবং বিনিয়োগ পরিকল্পনা চালু করতে হবে, যাতে তারা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে আরও আগ্রহী হয়। তাদের জন্য রেমিট্যান্স প্রবাহের পদ্ধতি এ নীতি নির্ধারণী সহজ করে অকারণে হয়রানি বন্ধ করতে হবে।তাতে তাদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে উৎসাহিত করা যাবে।
তৃতীয়ত, ঋণ পুনর্গঠন বা পুনঃতফসিলিকরণের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। ঋণের শর্তাবলী পুনর্বিবেচনা করে সুদের হার কমানো এবং পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি করতে পারলে বাংলাদেশের জন্য এই চাপ কিছুটা লাঘব হবে। এজন্য বাংলাদেশের বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোকে কূটনীতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এগিয়ে আসতে বলা যেতে পারে। এ ছাড়াও, সরকারকে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করা, কর ব্যবস্থার সংস্কার, এবং দুর্নীতি রোধের মাধ্যমে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা গেলে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বড় সুবিধা পাওয়া যাবে।
অবশেষে বলা যায়, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২৪ -২০১৫ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের উপর ঋণের বোঝা ৪.১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে পারে। তবে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের সঙ্গে সমন্বিত আলোচনা করে ঋণের শর্তাবলী পুনর্গঠন করা সম্ভব হলে, এই চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।যেন দেশ খেলাপি না হয়ে তার ঋণ যথাযথভাবে পরিশোধ করে তার সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হতে পারে।