ছোটবেলা থেকেই ব্যবসা করার ইচ্ছে ছিল নাফিজ আজাদের। তাঁর মা-বাবা এই স্বপ্নের কথা জানতেন। সম্প্রতি, ১৮ সেপ্টেম্বর, এক ভ্যানে অল্প কিছু খাবার এবং একটি চুলা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র নাফিজ এখন তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছেন। এমন বয়সে, যখন সাধারণত তার সমবয়সীরা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া কিংবা গেম খেলার মধ্যে সময় কাটায়, নাফিজের পদক্ষেপটি সত্যিই প্রশংসনীয়।
শুরুতে ভ্যানের মাধ্যমে খাবার বিক্রি করলেও, দ্রুতই তিনি সাফল্য অর্জন করেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে নিজস্ব ফুড কোর্টে খাবার বিক্রি শুরু করেন। সম্প্রতি, আশ্বিনের ঝুম বৃষ্টির মাঝেও নাফিজের দোকান দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষা শেষে স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যায় তাঁর দোকানে কাজ শুরু করেন তিনি। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত খাবার পরিবেশন করে থাকেন।
রিং রোডের সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের পাশে গড়ে ওঠা ফুড কোর্টে নাফিজের দোকানটি একটি বিশেষ আকর্ষণ। যেখানে অন্যান্য দোকানে দামি খাবার বিক্রি হচ্ছে, সেখানে নাফিজের ফুড কর্নারে খাবার পাওয়া যাচ্ছে সাধ্যের মধ্যে। তিনি জানান, বর্তমানে ৭ ধরনের খাবার বিক্রি হচ্ছে, যার দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। ডাবের পুডিং ৩০ টাকা, নুডলস, স্যুপ, এবং ভ্যানিলা বাদাম জুস ৪০ টাকায় পাওয়া যায়, আর তান্দুরি চিকেন ও সাসলিক ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নাফিজ বলেন, “স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করেই এমন দাম নির্ধারণ করেছি। আমি নিজেও একজন শিক্ষার্থী, তাই অন্যদের পকেটের অবস্থা জানি।” ব্যবসার শুরুতেই সাফল্য পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত। “এখন পর্যন্ত খুব ভালো রেসপন্স পাচ্ছি। সবাই প্রশংসা করছে। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলেই মানসিকভাবে সাপোর্ট করছেন এবং কাস্টমারও আসছে প্রচুর,” তিনি যোগ করেন।
নাফিজের বাবা আবুল কালাম আজাদ, যিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী, ছেলের ব্যবসার পরিকল্পনা শুনে বলেন, “যা-ই করবে, পড়াশোনা ঠিক রেখে করতে হবে।” তিনি নাফিজের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আরও বলেন, “বহির্বিশ্বে ঘোরাঘুরি করার চেয়ে এই সময়টা এখানে দেওয়া অনেক ভালো। দেখুন, দেখতে দেখতে ব্যবসা শিখে যাবে। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরার চেয়ে যদি এটাকেই আরেকটু ডেভেলপ করতে পারে, তাহলে তো ভালো।”
ফেসবুকে নাফিজ যখন তাঁর ফুড কোর্ট শুরু করার কথা জানিয়ে একটি পোস্ট দেন, তখন তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ তাঁর উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান। একজন মন্তব্যকারী, ইসমাইল, বলেন, “সোসাইটাল ম্যান্টালিটিকে উপেক্ষা করে কিছু করার মতো সাহস আজ অব্দি জন্মায়নি। আমি আপনার সাহসকে স্যালুট জানাই।”
নাফিজের দোকানে আসা দর্শকদের মধ্যে তাঁর শিক্ষক এবং বন্ধুদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আমরা ছাত্রদের সবসময় শেখাই, তোমরা এমন কিছু করো যাতে তোমাদের চাকরি খুঁজতে না হয়। বরং মানুষকে চাকরি দিতে হবে।”
নাফিজের বন্ধু মাশরুর মাহবুব আফনান তাঁর গর্ব প্রকাশ করে বলেন, “আমার বন্ধু অনেক সাহসী। ক্লাস নাইনে থেকে সে যা করছে, তা অনেকের পক্ষে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরেও করা সম্ভব নয়।” আরেক বন্ধু আদর আশরাফ যোগ করেন, “নাফিজের এই উদ্যোগ সমাজে একটি পজিটিভ ম্যাসেজ দেবে।”
নাফিজের দোকানে তাঁকে সাহায্য করছে আরও দুইজন শিক্ষার্থী। ভবিষ্যতে তিনি এমন কিছু করার পরিকল্পনা করছেন, যাতে আরও অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন। “আমি মূলত স্টুডেন্টদের নিয়েই কাজ করতে চাই। ভবিষ্যতে যেকোনো কাজে শিক্ষার্থী ভাইবোনদের সাথে নিয়ে করার চেষ্টা করবো,” বলেন তিনি।
নাফিজের সফলতার গল্পটি ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হতে চাওয়া তরুণদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, “বিদেশে প্রেসিডেন্টের ছেলে-মেয়েদেরকেও কাজ করতে হয়। বাংলাদেশে কেউ কিছু করতে চাইলে অর্ধেক মানুষ নেতিবাচক মন্তব্য করে। তবে তা কানে নেওয়া যাবে না। আমি বলবো, শুধু পরিকল্পনা করলেই হবে না, কাজ শুরু করে দিতে হবে।”
নাফিজের মতে, “আজ থেকে ১০ দিন আগেও জানতাম না আমি এই অবস্থানে আসবো। প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পেরেছি বলেই সম্ভব হয়েছে।”
এই কিশোরের সাহসী পদক্ষেপ সত্যিই অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে এবং আমরা আশা করি, তাঁর মতো আরও অনেক উদ্যোক্তা ভবিষ্যতে আমাদের সমাজে আত্মপ্রকাশ করবে।