আফ্রিকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন ঐতিহাসিকভাবে একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। আফ্রিকা মহাদেশের ইতিহাস বিভিন্ন সংঘাত, ঔপনিবেশিক শাসন এবং ক্ষমতার পরিবর্তনের সাক্ষী।আফ্রিকায় একসময় ঔপনিবেশিক শাসন ও সামরিক শাসনের ছায়া গভীরভাবে বিরাজ করলেও তা এখন ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে এই মহাদেশের বেশিরভাগ দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবেশের চেষ্টা করেছে কিন্তু পথটি কখনোই মসৃণ ছিল না। রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি এবং দীর্ঘমেয়াদী শাসনের কারণে এই যাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবুও, কিছু দেশে সফল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যা অন্যান্য দেশের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসনের পরে দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে।
আফ্রিকায় গণতন্ত্রের উত্থান-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল, পরে দেশগুলো বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা লাভ করতে শুরু করে। ১৯৬০-এর দশকে আফ্রিকার বহু দেশ স্বাধীনতা লাভ করে, যা গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। আফ্রিকার দেশগুলো উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেতে শুরু করে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯৫১ সালে লিবিয়া প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে স্বাধীনতার গতি বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে ১৯৬০ সালকে বলা হয় “আফ্রিকার বছর “। কারণ সেই বছরে ১৭টি আফ্রিকান দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বেশিরভাগ আফ্রিকান দেশই স্বাধীন হয়, তবে কিছু দেশ যেমন জিম্বাবুয়ে (১৯৮০) এবং নামিবিয়া (১৯৯০) আরও পরে স্বাধীনতা লাভ করে। তবে ১৯৮০-এর দশক থেকে আফ্রিকায় গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের ঢেউ দেখা দেয়। অনেক দেশ একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিক ,কেনিয়া এবং নাইজেরিয়া আফ্রিকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাফল্য-
আফ্রিকার রাজনৈতিক ইতিহাস দীর্ঘদিন ধরে উপনিবেশবাদ, গৃহযুদ্ধ এবং স্বৈরশাসনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক কয়েক দশকে, আফ্রিকার অনেক দেশ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সাফল্য সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি বড় সাফল্য হলো ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা।
এক্ষেত্রে কিছু দেশের গণতান্ত্রিক পথে যাত্রার কথা উল্লেখ করা যায় –
নাইজেরিয়া: ২০১৫ সালের নির্বাচনে মুহাম্মাদু বুহারি বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটে। এটি ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশ নাইজেরিয়ার প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, যা আফ্রিকায় গণতন্ত্রের শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
সেনেগাল: সেনেগাল গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার জন্য পরিচিত। ২০১২ সালে সেনেগালে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট আবদুলায়ে ওয়াদ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ম্যাকি সালের কাছে। সেনেগালের খুবই শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া এ নির্বাচন একটি উদাহরণ হিসেবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি সফল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।
ঘানা: ঘানা একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত। ঘানা আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং তার পর থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ১৯৯২ সালে বহুদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটিতে একটি নতুন সংবিধান গৃহীত হয়, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করে। এরপর থেকেই ঘানা নির্দিষ্ট সময়মত নির্বাচন আয়োজনের জন্য খ্যাতি লাভের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই সাফল্য ঘানার সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করেছে। ঘানায় শান্তিপূর্ণভাবে নিয়মিত ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটে। বিশেষ করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্য দেখিয়েছে।
কেনিয়া: কেনিয়ার গণতন্ত্রের বিকাশে গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এদের প্রচেষ্টার ফলে সরকারকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। কেনিয়াও আফ্রিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ২০০২ সালে কেনিয়া একটি ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনে, যা দেশটিকে রাজনৈতিক সংস্কার এবং সুশাসনের দিকে নিয়ে যায়। দেশটি বহুদলীয় নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করে নাগরিকদের অধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। ২০১০ সালে নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও শক্তিশালী হয়েছে, যা কেনিয়াকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা: দক্ষিণ আফ্রিকার গণতন্ত্রের সাফল্য ১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে জাতিগত বর্ণবাদী শাসনের অবসান দিয়ে শুরু হয়। এরপর দেশটি একটি শক্তিশালী সাংবিধানিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যা সেখানে মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের অধিকার সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা আজ বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত, তবে অর্থনৈতিক অসাম্য এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির মতো চ্যালেঞ্জগুলো এখনও বিদ্যমান।
তানজানিয়া: তানজানিয়ার গণতন্ত্রের সাফল্য ১৯৯২ সালে বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তনের পর থেকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এরপর থেকে সেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা হয়েছে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার নিয়ে তানজানিয়ায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এমনকি সেখানে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ সমালোচিত হচ্ছে। তবে তানজানিয়া তার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, যা দেশের উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে।
রুয়ান্ডা: গণতন্ত্রের বিকাশের পাশাপাশি রুয়ান্ডা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক সাফল্য দেখিয়েছে। ১৯৯৪ সালের ভয়াবহ গণহত্যার পরে, দেশটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করে (এই হত্যাকাণ্ড দীর্ঘস্থায়ী জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং চরমপন্থী হুতু নেতাদের উস্কানির ফলে সংঘটিত হয়)। বর্তমানে রুয়ান্ডার অর্থনীতি পূর্ব আফ্রিকার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে পড়ে। রুয়ান্ডার পার্লামেন্টে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ৬৪ শতাংশ নারী সদস্য নিয়ে রুয়ান্ডা নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
বোতসোয়ানা: বোতসোয়ানার গণতন্ত্রের সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও একটি শক্তিশালী বহুদলীয় ব্যবস্থার ফলস্বরূপ। ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই দেশটি নিয়মিতভাবে মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করেছে এবং মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে। বোতসোয়ানা আফ্রিকার অন্যতম স্বচ্ছ সরকার হিসেবে পরিচিত, যেখানে দুর্নীতির মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম।
লিবারিয়া: লাইবেরিয়ার গণতান্ত্রিক সাফল্য ২০০৫ সালে এলেন জনসন সার্লিফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে শুরু হয়, যিনি তখন আফ্রিকার প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি হন। গৃহযুদ্ধের পর থেকে সেদেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠিত হয়েছে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া উন্নত হয়েছে। তবে, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো এখনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। লাইবেরিয়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে কাজ করে চলেছে এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আফ্রিকায় গণতন্ত্রের গুরুত্ব-
আফ্রিকায় গণতন্ত্রের বিকাশে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আফ্রিকান দেশগুলোর গণতান্ত্রিক শাসনের উন্নয়নে অর্থায়ন, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সহযোগিতা করেছে।
আফ্রিকান ইউনিয়ন(এ ইউ) তার সদস্য দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক শাসন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এবং সংকট সমাধানে সহযোগিতা করা হয়েছে।
জাতিসংঘের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ দল এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের সহায়তায় ২০২৩ সালে সিয়েরা লিওন এবং লিবারিয়ায় সফল ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
আফ্রিকার এ দেশগুলোর গণতন্ত্রের যাত্রা থেকে বোঝা যায় যে, গণতান্ত্রিক সাফল্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার রক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে দেশগুলো এগিয়ে গেছে। এছাড়াও গণতন্ত্রের সুফল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণ, সুশীল সমাজ ও নাগরিক অংশগ্রহণের বিকাশ ও গণতন্ত্রের সফলতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় চ্যালেঞ্জ-
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাফল্যের পাশাপাশি আফ্রিকার অনেক দেশে গণতন্ত্র এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।
আফ্রিকার অনেক দেশে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার গণতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই কারণে জনমনে হতাশা দেখা দেয় এবং গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়। নির্বাচনী সহিংসতার কারণে কিছু দেশে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না, এছাড়া নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা ও ক্ষমতার লড়াই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। একনায়কতন্ত্রের পুনরুত্থানের ফলে কিছু দেশে একদলীয় শাসন বা সামরিক শাসনের দিকে ঝুঁকছে, যেমন সাম্প্রতিক সময়ে নাইজার এবং মালি। উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং দারিদ্র্যও গণতন্ত্রের প্রসারকে বাধাগ্রস্ত করছে, কারণ আফ্রিকার জনগণ প্রায়ই বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করে। আবার শিক্ষার অভাব ও গণসচেতনতার অভাব অনেক সময় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া, বিদেশি হস্তক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক প্রভাবও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা তৈরি করে, যা গণতন্ত্রের বিকাশকে ব্যাহত করছে।
এক্ষেত্রে কিছু দেশের বাস্তব উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোঝা যাবে। যেমন লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনের মতো দেশে গৃহযুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাস স্পষ্ট। এই দেশগুলোতে গৃহযুদ্ধের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, জিম্বাবুয়েতে দুর্নীতি এবং একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হয়। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের উদাহরণ হিসেবে গিনির কথা বলা যায়, যেখানে প্রেসিডেন্ট বহু বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায় নেই। নাইজেরিয়া এবং কঙ্গোতে দুর্নীতি ও নির্বাচনী সহিংসতা গণতন্ত্রের বিকাশে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া, সোমালিয়া এবং দক্ষিণ সুদানের মতো দেশে নিরাপত্তাহীনতা ও সন্ত্রাসবাদের কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরভাবে কাজ করতে পারছে না।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা-
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আফ্রিকায় উজ্জ্বল হলেও এর সুফল পেতে হলে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলোকে আগে মোকাবিলা করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আফ্রিকার গণতান্ত্রিক উন্নয়নকে সমর্থন করে আসছে। এই সমর্থন অব্যাহত থাকলে গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব লাভ সম্ভব।
কিছু মৌলিক পরিবর্তন ও উদ্ভাবনী কৌশল তাদের গণতন্ত্রকে মজবুত করতে পারে এবং নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। কেননা আফ্রিকার জনসংখ্যার বিশাল অংশই তরুণ। তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে পারে। নাইজেরিয়ার “এন্ডসার্স” আন্দোলন তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতার উদাহরণ, যা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এছাড়া ইন্টারনেটের প্রসার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার মানুষকে তাদের মতামত প্রকাশ এবং রাজনৈতিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই সুবিধা রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এ জন্য আফ্রিকায় জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ, রাজনৈতিক সংস্কার এবং সুশাসনের উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করছে।
বাস্তবতার আলোকে বলা যায়, আফ্রিকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাফল্যগুলো যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে অবশ্যই একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ায় যুবসমাজের ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সমর্থন বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে। গণতন্ত্রের পথে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হলে, আফ্রিকা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারবে।
লেখক- কাজি মোঃ বদরুদ্দোজা হেলাল