বিশ্বজুড়ে যখন পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA), তখন ইরান সংস্থাটির নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সম্প্রতি ইরানের পার্লামেন্ট থেকে ঘোষণা এসেছে—তারা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা এর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করতে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সামরিক হামলা এবং সংস্থাটির নীরবতা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ।
২০১৫ সালে ইরান ‘পি ফাইভ প্লাস ওয়ান’ (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া ও জার্মানি) দেশের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তিতে পৌঁছায়। এর ভিত্তিতে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমে নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা-কে। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি বাতিল করার পরই শুরু হয় উত্তেজনার নতুন অধ্যায়।

চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কাজের গতি বাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটি ইতোমধ্যেই প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে—যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে একটি বড় পদক্ষেপ।
গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, এরপর ১০ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও সামরিক অভিযান চালায় ফোর্দো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, এসব হামলায় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে। যদিও মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, ইউরেনিয়ামের মজুদ এবং সেন্ট্রিফিউজগুলো মূলত অক্ষত রয়েছে—ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কেবল অবকাঠামোতে।
এই হামলাগুলোর পর ইরান অভিযোগ করেছে, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা নিরব ছিল এবং কার্যত কোনো সুরক্ষা বা প্রতিক্রিয়া দেয়নি। ইরানি পার্লামেন্ট দাবি করেছে, সংস্থাটি “রাজনৈতিক হাতিয়ারে” পরিণত হয়েছে এবং তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা-এর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে তেহরান।
ইরানের সংসদে সর্বসম্মতভাবে একটি বিল পাস হয়েছে—যেখানে বলা হয়েছে, যদি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে সিসিটিভি নজরদারি, পরিদর্শন এবং তথ্য রিপোর্টিং বন্ধ থাকবে। ইরান স্পষ্ট করে বলেছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় না, তবে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে এখন সহযোগিতা সীমিত করা ছাড়া উপায় নেই।

এই উত্তেজনার মধ্যেই জানা গেছে, ইরান একটি নতুন, শক্তভাবে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনা নির্মাণ করেছে, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এর অবস্থান সম্পর্কে জানে না এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলও। ধারণা করা হচ্ছে, মূল ইউরেনিয়াম মজুদ এখন সেখানে স্থানান্তরিত হয়েছে।
এই গোপন স্থান আর পশ্চিমাদের গোয়েন্দা তথ্যের সীমাবদ্ধতা—উভয়ই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা-এর প্রধান রাফায়েল গ্রসি পরিষ্কার করে বলেছেন—পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। জেনেভা কনভেনশনের ৫৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পারমাণবিক স্থাপনায় সামরিক আক্রমণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও এই হামলার তীব্র নিন্দা এসেছে পাকিস্তান, রাশিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে।
বিশেষ করে রাশিয়া স্পষ্ট বলেছে—যে হামলা চালানো হয়েছে, তা ইরানকে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা-এর সহযোগিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। এতে সংস্থাটির নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
সংঘাতের মাঝেও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা প্রধান রাফায়েল গ্রসি বলেছেন, তাঁর সংস্থা এখনো ইরানে ফিরে গিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়। তিনি কূটনৈতিক আলোচনার একটি ‘জানালা’ খোলা থাকার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, এখন সময় একে কাজে লাগানোর, নষ্ট করার নয়।
হামলায় বাস্তব ক্ষতির মাত্রা এবং ইরানের ইউরেনিয়াম মজুদের বর্তমান অবস্থা পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও, প্রশ্ন উঠেছে—ইরান কি আরও দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগোবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তর কোরিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে ইরান হয়তো শিখেছে—পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে আক্রমণের ভয় কমে যায়।
এখনো যুদ্ধবিরতি বলবৎ থাকলেও, পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা শুরু হলেও, তাতে সফলতা আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার—ইরানের মাটিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কোনও কর্মসূচি চলতে দেওয়া হবে না। কিন্তু ইরান তা কখনোই মেনে নেয়নি।
এই সংকটের ভেতরে একটি বিষয় পরিষ্কার—আন্তর্জাতিক আস্থা, নিরাপত্তা, এবং কূটনীতির ভারসাম্য এখন অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ এক চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।