নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর জোহরান মামদানি তাঁর সমর্থকদের সামনে নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি তুলে ধরেন, “নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষায়, ‘যে কাজটা অসম্ভব মনে হয়, তা তখনই সম্ভব হয় যখন সেটা করা হয়।’ আমার বন্ধুরা, আমরা সেটা করে দেখিয়েছি।” এই কথায় সমর্থকদের উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো ছিল।
কয়েক মাস আগেও জোহরান মামদানি ছিলেন কুইন্স থেকে নির্বাচিত মাত্র ৩৩ বছরের এক রাজ্য আইনসভার সদস্য, যাকে অনেকেই কেবলমাত্র এক আদর্শবাদী হিসেবে দেখতেন, যিনি বড় কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়তে পারবেন না। তাঁর মাতা মীরা নাইর, বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, আর পিতা প্রফেসর মাহমুদ মামদানি, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
অপরদিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অ্যান্ড্রু কুমো, নিউ ইয়র্কের সাবেক গভর্নর, যিনি কোটি কোটি ডলার ও বিশাল মিডিয়া সমর্থন পেয়েছিলেন। তবু প্রাইমারি ভোটে বিজয়ী হলেন মামদানি। নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা আলাদা কথা, কিন্তু এখন যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো মামদানির এই বিজয় থেকে বাংলাদেশি তরুণ রাজনীতিবিদদের শেখার সুযোগ।
মাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা—সফলতার মূল চাবিকাঠি
মামদানি কোনো গ্লিটজ বা রাজনৈতিক বংশগতি নয়, কঠোর পরিশ্রম ও জনসাধারণের হৃদয়ে নিজেদের স্থান করে নেওয়ার মাধ্যমে এই জয় অর্জন করেছেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা শুরুতেই কেউ তাকে গুরুত্ব দেয়নি। কুইন্সের আইনসভায় তার আইন প্রণয়নের রেকর্ডও বেশ সাধারণ ছিল।
তবুও তাঁর রয়েছে এক বিশেষ গুণ: স্পষ্টতা, সততা ও সেবার আগ্রহ। তাঁর প্রচারণার মূল বিষয় ছিল সাধারণ কর্মজীবী নিউইয়র্কবাসীর দৈনন্দিন সমস্যাগুলো—উচ্চ ভাড়া, চাইল্ডকেয়ার-এর অভাব, ভাঙা যানবাহন ব্যবস্থা। এসব বিষয়গুলোকে তিনি সরল ভাষায় তুলে ধরেছেন, যেন প্রত্যেকটি মানুষের টেবিলে সেই আলোচনা হচ্ছে।
মামদানির প্রচারণা অফিস ছিল শহরের মেয়াদী হোটেল, দাতব্য সম্মেলন বা বড় সভা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন এক মিলিয়ন দরজায় কড়া নাড়বেন। নিজে এবং তাঁর টিম নিউ ইয়র্কের প্রতিটি কোণা ঘুরে নির্বাচনী সভা করেছেন, মেট্রোর স্টেশনে মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, রমজানের সময় ট্রেনে ইফতার করার ভিডিও প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, “আমরা এমন একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছি যেখানে প্রতিদিনের নিউইয়র্কবাসী নিজেদেরই পরিচয় পায় আমাদের গণতন্ত্রের স্বপ্নে।”
এই গণমানুষের সমর্থনই ছিল তাঁর শক্তি। বৃষ্টিতে ছুটে বেড়ানো স্বেচ্ছাসেবীরা, বহুভাষিক প্রচার ভিডিও, ছোট দাতাদের মাধ্যমে ১৫ লাখ ডলার তোলার ক্ষমতা—এই সব মিলেই গড়ে উঠেছে মামদানির সফলতা।
ডিজিটাল দক্ষতা আর স্থানীয় আস্থা
মামদানির প্রচারণার কেন্দ্রে ছিল আধুনিক যোগাযোগের দক্ষতা। তবে এটি শুধুমাত্র ভাইরাল হওয়ার জন্য নয়, বরং সৎ ও আন্তরিকতার জন্য।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় এবং সহজ দৃশ্যাবলীতে বার্তা দিয়েছেন। হিন্দি ভাষায় ভিডিও করে ভারতীয় আমেরিকানদের কাছে পৌঁছেছেন, স্প্যানিশ ভাষায় স্প্যানিশভাষী সম্প্রদায়কে বলেছেন, আর বাংলা ভাষায় কথা বলেছেন বাংলাদেশি-আমেরিকানদের সঙ্গে। এই ধরনের ভাষাগত সংযোগ অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরি করেছে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অনেক রাজনীতিবিদ এবং সমাজ নেতা যেমন শাহানা হানিফ ও মাফ মিসবাহ উদ্দিন তাঁর পক্ষে প্রচুর সমর্থন দিয়েছেন। বলিউড রেফারেন্স, র্যাপ করা পলিসি পয়েন্ট বা ভোটারদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলার মাধ্যমে তিনি সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন যা নিছক অভিনয় নয়, প্রকৃত।
“কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়া সরাসরি মানুষের জীবনের সমস্যাগুলোতে কথা বলা,” মামদানির নিজের ভাষায়, “এই ‘অনুবাদহীন রাজনীতি’ মানুষদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য হয়েছে।”
স্পষ্টতা ও বাস্তবতার মিল
মামদানির আরেকটি বড় শক্তি ছিল জটিল সমস্যাগুলোকে সহজ, স্পষ্ট ও প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবে রূপান্তর করা। ভাড়া ফ্রিজ করা, বিনামূল্যে বাস চালানো, সর্বজনীন চাইল্ডকেয়ার—এই সব প্রস্তাবনা বাস্তব জীবনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে ছিল।
টিভি ডিবেট কিংবা আলোচনায় তিনি এসব নীতি নিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে সংযোগ রেখেছেন, কখনো বড় হওয়ার ভান করেননি, কখনো অবজ্ঞা দেখাননি। বন্ধুত্বপূর্ণ কিংবা কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি ছিলেন সংযত, স্পষ্ট ও প্রাণবন্ত।
বাংলাদেশে জাতীয় সিটিজেন পার্টি (NCP) ও ইউনাইটেড পিপল’স (UP) বাংলাদেশের মতো তরুণ রাজনীতি দলগুলো যখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তখন মামদানির এই রকম স্পষ্ট, সততাভিত্তিক ও জীবনভিত্তিক রাজনৈতিক ভাষা আমাদের জন্য এক আদর্শ।
বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশেরও বেশি তরুণ প্রার্থী যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই, তাদেরকেই ভোট দিবেন। প্রায় ৭৫ শতাংশ তরুণ ভোটার মনে করেন প্রার্থীর জন্য বয়সসীমা কমানো উচিত, আর ২৫ শতাংশ নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পক্ষপাতী।
প্রস্তুতি আর ধৈর্যের দরকার
২০২৬ সালের নির্বাচনের মুখে বাংলাদেশে তরুণদের রাজনৈতিক চেতনা আগের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু এখন চ্যালেঞ্জ হলো—এই তরুণ আন্দোলনগুলো কীভাবে তাদের গতি ধরে রাখতে পারে এবং রাজনৈতিক কাঠামোতে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারে?
এখানেই মামদানির প্রচারণা থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়া যায়—ব্যক্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কাঠামো জয়ী হয়। বাংলাদেশি নতুন নেতাদের পুরনো রাজনৈতিক পন্থার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেমন, ‘নয়া বন্দোবস্ত’ শ্লোগান দিয়ে অনেকেই মঞ্চে থাকেন, কিন্তু মামদানির মতো বাস্তবে তা কার্যকর করা আলাদা।
অনেক তরুণ ভোটার আজকের দিন পর্যন্ত কোনো সত্যিকারের সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন দেখেনি। পুরনো রাজনৈতিক পন্থাগুলো থেকে তারা হতাশ। এখন তরুণদের হাতে সুযোগ আছে তাদের হতাশাকে বাস্তব রাজনৈতিক পরিবর্তনে রূপ দেওয়ার, আর তা হলে নতুন, স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক রাজনীতির সূচনা হবে।
মামদানির বক্তব্যে ছিল, “আমরা আমাদের গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করেছি। আমরা আমাদের শহরকে আবার বিশ্বাস করার সুযোগ দিয়েছি।” বাংলাদেশের তরুণ নেতারা যদি জনসাধারণের সঙ্গে মিশে থাকেন, তরুণ ভোটারদের দাবিগুলো বুঝতে পারেন এবং তাদের বার্তা ধারাবাহিক ও স্পষ্টভাবে পৌঁছে দিতে পারেন, তাহলে তারা নিজ দেশকেও আবার বিশ্বাস করার সুযোগ দিতে পারবেন।
বাংলাদেশের তরুণ রাজনীতিবিদরা কি এই সুযোগ কাজে লাগাতে প্রস্তুত? সময়ই বলে দেবে।সূত্র: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড