সেদিন ভোরে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টির পর আকাশটা কিছুটা পরিষ্কার হয়েছিল। গ্রামটা তখনও অর্ধেক নিদ্রামগ্ন, আর বাকিরা জেগে উঠছে সকালবেলার কাজে। পথের পাশের ফাঁকা জায়গাটা কাঁদায় ভরা, একটুখানি জমে থাকা জলকাদা থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল। গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন পথ, যে পথে দিয়ে গ্রামবাসীরা তাদের কাজের উদ্দেশ্যে যেতে আসতে হয়-সেখানেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল।
একটা মৃতদেহ। অচেনা অজানা শুয়ে আছে নিস্তব্ধতায়। গ্রামের প্রথম কয়েকজন যাত্রীর চোখে ধরা পড়ল লাশটা। কেউ প্রথমে কাছে যেতে সাহস পেল না, দূর থেকেই তাকিয়ে থাকল। মাটির পথের ধারে পড়ে থাকা নিথর দেহটা যেন এক ভয়াবহতা মিশ্রিত কৌতূহল তৈরি করছিল।
একটু পরে ভিড় জমতে লাগল। ধীরে ধীরে গ্রামবাসী জড়ো হতে শুরু করল। প্রতিটি মানুষের মুখে একটি প্রশ্ন, “এ লাশটা এখানে এলো কীভাবে? কে এই মানুষ? কেন এখানে পড়ে আছে?” তাদের চোখে ভয়ের ছায়া, কপালে দুশ্চিন্তা। গ্রামের প্রবীণ মুরুব্বি মাওলানা সাহেব আসেন। তার সাদা দাড়ি আর শান্ত দৃষ্টি যেন সবার মনে কিছুটা সাহস জোগায়।
গ্রামের পুরনো কাবুলি মিয়া বলেন, “ভাই, এটা তো আমাদের গ্রামের কেউ নয়। তাহলে এটা আমাদের দায়িত্ব কিসের? অন্য গ্রাম থেকে কেউ এখানে ফেলে রেখে গেছে হয়তো।” তার কথা শুনে আরো অনেকে মতামত দেয়, “হ্যাঁ আমরাও তো জানি না কে এই লোক। কোথা থেকে আসলো, কেন এখানে মরল?”
তবুও কেউ কেউ বলে, “মৃত মানুষকে এভাবে ফেলে রাখা কি ঠিক হচ্ছে? তারও তো সৎকারের অধিকার আছে। আমরা কি আমাদের মানবিক দায়িত্ব এড়াতে পারি?”
মাওলানা সাহেব মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছিলেন সবার কথা। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, “লাশটাকে সৎকার করা উচিত। জানি না সে কে, কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু আমাদের ধর্ম বলে, মৃতের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। সৎকারের দায়িত্ব আমাদেরই।”
তার কথাগুলো শুনে কিছু মানুষ সরে যায়; তারা ভয়ে বা দ্বিধায় যুক্তি দেখায়। কেউ কেউ বলে, “কেন আমরা এর দায় নেবো? যদি এটা কোনো খারাপ কাজে জড়িত থাকে? আমাদের কোনো বিপদ আসবে না তো?” আবার কেউ বলে, “এ তো আমাদের কেউ নয়, কেন আমরা এর ভার নিবো?”
গ্রামের প্রাচীন এক বৃদ্ধা চাচি বলে ওঠেন “বাবারা এ তো জীবন-মৃত্যুর কথা। মানুষ মারা গেলে তার দেহকে শান্তি দেওয়া আমাদের কাজ। আজ আমরা যদি তার দায়িত্ব না নিই, কাল কেউ আমাদের দায়িত্ব নেবে না। চাকা যেমন ঘুরছে, তেমনই জীবনের চক্রও চলছে।”
তার এই কথাগুলো গ্রামবাসীর মনে ছাপ ফেলে। তারা বুঝতে পারে, জীবন-মৃত্যুর চক্রে সবই ফিরে আসে। হয়তো তাদের দায়িত্ব এড়ানোর অধিকার নেই।
অবশেষে তারা একসঙ্গে লাশটাকে কাঁধে তুলে নেয়। গন্তব্য গ্রামের পুরানো কবরস্থান, যেখানে তাদের পূর্বপুরুষদের দেহ মাটির নিচে শুয়ে আছে। মৃতের সৎকারে কেউ মাটি আনছে, কেউ কবরে নামানোর দড়ি ঠিক করছে। সবাই মিলেমিশে কাজ করছে, যেন এটি তাদের একটি পবিত্র দায়িত্ব।
কবর দেওয়ার সময় আকাশে গোধূলির আলো নিভে যেতে থাকে, রাতে ঢেকে যায় গ্রাম। গ্রামের সবাই মিলে লাশটিকে সমাধিস্থ করে, আর ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়। তাদের মনে এক ধরনের শান্তি এবং দায়িত্ববোধ থাকে। তারা হয়তো বুঝতে পারে, এভাবেই জীবন এক চক্রে চলতে থাকে। আজ তারা এই লাশটির দায়িত্ব নিয়েছে, একদিন তাদের জন্যও কেউ এই দায়িত্ব পালন করবে।
লাশটি গ্রামের মাটির নিচে চিরতরে মিশে যায়। আর গ্রামবাসীরা জীবনের নিয়মে ফিরতে থাকে, নতুন এক ভাবনা তাদের মনে রেখে-জীবন যেমন চলমান, তেমনই চক্রের ঘূর্ণনও চলবে অনন্তকাল ধরে।
সেলিম আল দীনের সাহিত্যকর্ম-
গল্পটির লেখক হলেন সেলিম আল দীন, যিনি বাংলা নাটকের অন্যতম উজ্জ্বল প্রতিভা। তিনি নাটক, গল্প, কবিতা এবং সাহিত্য সমালোচনা-সব ক্ষেত্রেই তাঁর অসাধারণ প্রতিভার ছাপ রেখেছেন। সেলিম আল দীন ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৮ সালে তাঁর মৃত্যু ঘটে। বাংলা নাটকের ইতিহাসে তাঁর অবদান অসাধারণ, বিশেষ করে গ্রামীণ জীবন, মানুষের সম্পর্ক এবং জীবন-মৃত্যুর আবহ তুলে ধরার ক্ষেত্রে।
সেলিম আল দীন আধুনিক বাংলা নাটকের মূল ভিত্তি গড়ে তুলেছেন। তাঁর নাটকগুলোতে সাধারণ মানুষের জীবন, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য অত্যন্ত নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে। তিনি গ্রামীণ জনগণের সমস্যা, তাদের আনন্দ ও বেদনাকে অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন। সেলিম আল দীনের সাহিত্যকর্মে সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে গেছে, যেখানে মানুষের জীবনের সমস্ত দিক-আশা, আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম এবং জীবনের সীমাবদ্ধতা—এগুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
“চাকা” নাটক-
গল্পটি “চাকা” নাটক থেকে অনুপ্রাণিত। নাটকটির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হলো জীবন ও মৃত্যুর অবধারিত চক্র। এখানে এক অজানা মৃতদেহ এবং তার সৎকারের প্রশ্নটি সমাজের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দায়িত্ববোধকে চ্যালেঞ্জ করে। নাটকের মাধ্যমে সেলিম আল দীন সমাজের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন-মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনি জীবনও একটি চক্রের মতো, যেখানে প্রত্যেকেরই দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে।
নাটকটি একটি গভীর ভাবনার উন্মোচন করে, যেখানে মানবিক সম্পর্ক, সামাজিক দায়িত্ব এবং জীবনের অমোঘ সত্য তুলে ধরা হয়েছে। নাটকের মাধ্যমে সেলিম আল দীন আমাদেরকে শিখিয়ে দেন যে, জীবনের প্রতিটি সৎকার, দায়িত্ব এবং সম্পর্কের ওপর আমাদের প্রতিদিন ভাবতে হবে।
সেলিম আল দীনের নাটকগুলোতে ব্যবহার করা ভাষা ও সংলাপগুলো প্রাণবন্ত, বাস্তবিক এবং গভীর। তাঁর লেখায় বাংলা লোকসংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং গ্রামের জীবনযাত্রার এক অনন্য প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়, যা বাংলা নাট্যজগতকে সমৃদ্ধ করেছে।