পোস্ট-মডার্নিজম, যে ধারাটি ২০ শতকের শেষার্ধে বিশ্বের সাহিত্যের আঙিনায় প্রবেশ করে, বাংলা সাহিত্যেও তার প্রভাব বিস্তার করেছে। এটি একটি সৃজনশীল আন্দোলন যা ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যকৌশল এবং প্রতিষ্ঠিত ভাবধারার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর, বাংলা সাহিত্যে এই প্রবণতা আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্কের সৃষ্টি করেছে।
পোস্ট-মডার্নিজমের মূল বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে ভাষার গতিশীলতা, অর্থের অনির্ধারিততা এবং বাস্তবতার প্রতি সন্দেহ। এ ধারা অনুসরণকারী লেখকরা সত্য, বাস্তবতা এবং চরিত্রের একেবারে নতুন ধারণা তুলে ধরেন, যা প্রথাগত সাহিত্যিক কাঠামোর বাইরে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই আন্দোলন প্রভাবিত করেছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস এমনকি নাটককেও।
বাংলা সাহিত্যে পোস্ট-মডার্নিজমের প্রভাব প্রথমে বিশেষ করে কবিতায় পরিলক্ষিত হয়। কবি ও লেখকরা traditional forms (ঐতিহ্যবাহী রীতি) থেকে বেরিয়ে এক নতুন চিন্তা এবং অভিব্যক্তি প্রকাশে মনোযোগী হয়েছেন। শামসুর রাহমান, সেলিনা হোসেন, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ লেখকরা বাংলা সাহিত্যে এই পরিবর্তনকে সূচিত করেছেন। তাদের লেখা এমন এক ধরনের চিন্তা প্রকাশ করে যা বহুলাংশে পাঠকের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে।
তবে, বাংলা সাহিত্য ও পোস্ট-মডার্নিজমের সম্পর্কের মধ্যে একটি অদ্ভুত বৈপরীত্যও রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আধুনিক বা পোস্ট-মডার্ন লেখকরা। তারা একদিকে একেবারে নতুন চিন্তা ও অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে সাহিত্যের বিকাশ ঘটিয়েছেন, অন্যদিকে পুরনো সাহিত্যকৌশল এবং ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেননি। বরং অনেক লেখক ঐতিহ্যকে রক্ষা করে, আবার সেই ঐতিহ্যকে নতুন ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক উপন্যাস বা গল্পে অনেক সময় পুরনো কাব্যিক ধারা বা পুরনো সামাজিক চিত্রায়ন সমৃদ্ধ করা হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলা সাহিত্যকে পোস্ট-মডার্নিজমের সাথে সম্পৃক্ত করা অনেকটা ‘ঐতিহ্য’ এবং ‘নতুনত্ব’ এর সমন্বয়ের মতো। বাংলা সাহিত্য প্রতিনিয়ত নতুন ধারণা ও শৈলীতে আবির্ভূত হতে থাকলেও, তার শিকড় হিসেবে ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা যায় না। এই নতুন লেখকদের ভাষা, চিন্তা এবং সাহিত্যকৌশল বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের প্রতি এক সশ্রদ্ধ সম্মান রেখে আগাতে চায়।
বাংলা সাহিত্যের এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, যেখানে নতুনত্ব এবং পুরনো রীতির মধ্যকার ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে, তা পাঠকদের কাছে আরো গভীর এবং চিন্তাশীল সাহিত্য সৃষ্টি করেছে। এই আন্দোলন সাহিত্যের পুরনো ধারণাগুলির মধ্যে নতুন আলো ঢেলে দিয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধতর পরিসর তৈরি করেছে যা ভবিষ্যতেও বিস্তৃত হবে।
পরিশেষে, পোস্ট-মডার্নিজম ও বাংলা সাহিত্যের সম্পর্ক একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যেখানে একদিকে প্রথাগত মূল্যবোধ ও ইতিহাসের প্রভাব বিদ্যমান।
অন্যদিকে আধুনিক চিন্তা এবং নতুন শৈলী সাহিত্যের অঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে। এভাবে, বাংলা সাহিত্য এক নুতন দিগন্তে পৌঁছেছে, যা অতীত ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন তৈরি করেছে।