সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা ‘বাংলার জ্যোতি’ জাহাজে একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যা দেশের নৌ পরিবহণ খাতে এক নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনার ফলে নিহত হয়েছেন জাহাজের একজন ক্যাডেট এবং তিনজন কর্মী। ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’ বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের দুটি তেলবাহী ট্যাংকার, এবং ‘বাংলার জ্যোতি’তে ঘটিত এই দুর্ঘটনা নতুন নয়; এর আগেও এখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
আমাদের দেশে তেলবাহী ট্যাংকারগুলো সমুদ্রে চলাচলের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত। জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হট-ওয়ার্ক। একটি জাহাজ, বাসের মতো পাতলা পাতের নয়, বরং এটি পুরু ইস্পাতের পাত, রড ও পাইপ দিয়ে নির্মিত। নোনা পানির প্রভাবে এসব জাহাজের বিভিন্ন অংশে মরিচা ধরে যায় এবং এ কারণে মাঝে মাঝে মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। বাসের মেরামতের তুলনায় জাহাজের মেরামত প্রক্রিয়া অনেক বেশি জটিল, যেখানে গ্যাস কাটিং এবং ওয়েল্ডিংয়ের প্রয়োজন হয়।
হট-ওয়ার্কের সময় অগ্নি স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কাজ শুরু করার আগে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়। প্রথমে ঝুঁকির মূল্যায়ন করা হয়, যেখানে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলোর তালিকা তৈরি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মাস্তুলের উপর কাজ করার সময় যদি কেউ পড়ে যায়, তাহলে সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য কাজ করার আগে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হয়।
কাজের প্রস্তুতির প্রথম ধাপে ডিটেইল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। এখানে ঝুঁকির মূল্যায়ন করা হয় এবং কাজ শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তারপর একটি কার্যকর কাজের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়, যা অফিসে পাঠাতে হয়। অফিসের মেরিন সুপার ও টেকনিক্যাল সুপার সবকিছু যাচাই করে, তারপর কাজের অনুমতি দেয়।
এরপর, হট-ওয়ার্ক চেক লিস্ট প্রস্তুত করা হয়, যেখানে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সকল নিরাপত্তামূলক সরঞ্জাম এবং প্রস্তুতি সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, হট-ওয়ার্ক যেখানে হবে, সেখানকার চারপাশে ফায়ার এক্সটিংগুইশার এবং ফায়ার হোস প্রস্তুত রাখতে হয়। বাতাসে কোনো বিপজ্জনক গ্যাসের উপস্থিতি নেই কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত গ্যাস চেক করার ব্যবস্থা করা হয়।
এছাড়া, যারা কাজ করবেন, তাদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে এসেছে কি না, সেদিকে নজর রাখা হয়। দায়িত্বশীল একজন সুপারভাইজার কাজের পরিবেশ তদারকি করে এবং সময়মতো ব্রিজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। যদি কোনো পাইপলাইনে কাজ করা হয়, তাহলে ওই পাইপলাইন আইসোলেট করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
সবশেষে, কাজের জন্য একটি ওয়ার্ক পারমিট প্রস্তুত করা হয়, যেখানে যারা কাজ করবে, তাদের স্বাক্ষর থাকে এবং ক্যাপ্টেন সাইন করে এই কাজের জন্য অনুমতি দেন।
‘বাংলার জ্যোতি’ জাহাজে ঘটিত এই বিস্ফোরণ দেশের জাহাজ শিল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুত্বকে আবারও প্রমাণ করে। এর ফলে কর্তৃপক্ষের কাছে আরো সচেতনতা এবং নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। নৌযানে কাজ করার সময় সঠিক প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়।
আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ: তেলবাহী আমেরিকান ঈগল ট্যাংকারের ক্যাপ্টেন