“পাগলা ঘোড়ার মতো আমরা ছুটে চলেছি। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতি আমাদের তাড়া করছে। আমরা ধেয়ে চলেছি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লক্ষ্যহীন গন্তব্যের দিকে। অথচ আমরা চেয়েছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানের বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব থেকে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে। তা করতে গিয়ে আমরা শুরু করি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। তা থেকেই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য স্বাধিকার আন্দোলন।”
দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের পক্ষে লেখালেখির পাশাপাশি স্বশরীরেও মাঠে থেকে আজীবন লড়াই করে গেছেন লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তবে বিরোধী মতাদর্শের কারও প্রতি অবিচার করা হলে এর বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন তিনি।এমনকি বাংলাদেশ যখন পোশাক শিল্পে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ঠিক তখনই তিনি বেছে নিলেন সেলাই বিহিন কাপড়। সুই-সুতায় যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি সেলাইবিহীন সাদা কাপড়ে মানবিক বিশ্ব গড়ার এক অসম্ভব মিশনে একাই নেমে পড়লেন।
সময়টা ২০০৩ সাল। যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাকে আক্রমণ করে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা শুরু করে, তখন তিনি এর প্রতিবাদে শান্তির রং সাদা কাপড় পরে প্রতিবাদ জানান। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির অনুসারী সেলাইবিহীন দুখণ্ড কাপড় পরে সেই যে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন।
একটি সংবাদপত্রে তিনি লিখেছিলেন-
ব্যক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। প্রযুক্তির অকল্পনীয় অগ্রগতি ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি তাকে তার সুপ্ত শক্তি পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার সব সুযোগ ও সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিতে পারে। গত ৪০-৫০ বছরে পৃথিবীতে এই অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটেছে। অতি অল্প সময়ে অতি বড় পরিবর্তনে মানুষের ভারসাম্য হারানো অস্বাভাবিক নয়।
ইন্টারনেটের সাহায্যে পরোক্ষ যোগাযোগে দূরত্ব কমে না, বরং বাড়তে পারে। শুধু দূরত্বই বাড়ে না, অপরাধপ্রবণতাও বাড়তে পারে। এখন সেই আশঙ্কাই পৃথিবীর বড় বড় দেশের নেতাদের চিন্তার কারণ হয়েছে। বিবিসি ফোর-এর পক্ষ থেকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স হ্যারি বারাক ওবামার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট মনে করেন, ইন্টারনেটের একটা ঝুঁকি হচ্ছে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় বসবাস করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য মানুষের পক্ষপাতমূলক ধারণাগুলোকে আরও শক্তিশালী করবে। তিনি বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে এই প্রযুক্তিকে কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন মতপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে টিকিয়ে রেখে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, যাতে এটি সমাজে বিভেদ তৈরি করবে না, বরং মানুষ নিজেদের ঐকমত্যের জায়গাটি খুঁজে পাবে।
উন্নততর প্রযুক্তির দ্বারা পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে, দূর হয়েছে নিকট, কিন্তু দূরত্ব থেকে গেছে। মানুষে মানুষে বেড়েছে দূরত্ব। ব্যক্তির পক্ষ থেকে যন্ত্রটি যোগাযোগ করছে, মানুষটি থাকছে দুর্ভেদ্য দেয়ালের অপর পাশে। তা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করেন না। বারাক ওবামা তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘অভিন্ন স্বার্থের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের জন্য খুবই শক্তিশালী উপায় সামাজিক মাধ্যম। এটি মানুষকে একে অপরকে জানার ও তাদের মধ্যে যোগাযোগের সুযোগ করে দিচ্ছে।’
একই চিন্তার ও একই মতবাদের মানুষ নিয়ে একটি সমাজ হয় না। মানুষকে ভিন্নমতের সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে হয়। সে জন্য ভিন্ন চিন্তার মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয়। ওবামা গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলেছেন তা হলো ‘ইন্টারনেট পরিসরের বাইরেও সামাজিকভাবে মেলামেশার প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ প্রার্থনালয়ে সাক্ষাৎ করবে, প্রতিবেশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। সামাজিক পরিসরে একে অপরকে জানার চেষ্টা খুবই জরুরি।’
হিংসায় উন্মত্ত বিশ্বে উপাসনালয়গুলোও আজ নিরাপদ নয়। নির্ভয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষেরাও কি যেতে পারছে মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায়, প্যাগোডায় বা সিনাগগে? গত কিছুদিনের মধ্যে পাকিস্তানে, মিসরে গির্জায় প্রার্থনারত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন কয়েক শ মানুষ। যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা কেউই হত্যাকারীদের ব্যক্তিগত শত্রু ছিলেন না। ব্যক্তিগতভাবে কেউ হয়তো তাঁদের চিনতেনও না। তবু কেন এই উন্মত্ততা ও নৃশংসতা?
আজকের পৃথিবীতে ধর্ম নয়, ধর্মীয় সম্প্রদায় বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতারা তাঁদের দেশের সব মানুষের নেতৃত্ব করার চেয়ে তাঁদের নিজের ধর্মের মানুষের নেতৃত্ব করতেই পছন্দ করছেন। তাতেও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু তাঁরা অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যে ঘৃণা সঞ্চার করছেন। তাঁরা হিংসা উসকে দিচ্ছেন। ঘৃণা ও হিংসা অপ্রকাশ্য থাকে না। তা প্রকাশ্য রূপ নিলে সংঘাত অনিবার্য।
পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে যেদিন ট্রাম্প নামক একজন নেতার আবির্ভাব ঘটে, তার পরদিন থেকে বিশ্ব আর আগের মতো থাকতে পারে না। বিগত বছরের শেষ দিকে তিনি যখন তিনটি ধর্মের পবিত্র স্থানকে হিংসার রাজনীতির উপলক্ষ করেন, তখন তা যে বিশ্বব্যাপী আগুন জ্বালাবে, তা তিনিও জানতেন। জেনেই তিনি তা করেছেন। বর্তমান বছরটিকে অশান্ত করার উদ্দেশ্যেই তিনি জেরুজালেম-ষড়যন্ত্র পাকিয়েছেন। তিনি যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছেন, তা থেকে পৃথিবীতে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।
ট্রাম্পের পূর্বসূরি ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়ের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে বলেন, দায়িত্ব খুবই কঠিন। বিভিন্ন কারণে মানুষের দৃষ্টিতে অপ্রিয় হয়ে যেতে হয়।’ কথাটি সঠিক, তবে অন্যায় ও অপ্রিয় কাজ করলে মানুষের কাছে অপ্রিয় হওয়াই স্বাভাবিক। সব দেশের সব শাসকের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির দায়ে ২৫ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পেরুর সাবেক প্রেসিডেন্ট আলবের্তো ফুজিমোরি সাজা ভোগ করছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট পেদ্রো পাবলো কুচজিনস্কি তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন তাঁর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে। কিন্তু দেশের মানুষ তাঁকে ক্ষমা করতে চাইছে না। তারা ক্ষমার সিদ্ধান্তে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। জনগণের ক্ষমা না পাওয়ায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফুজিমোরি বলেছেন, ‘আমি জানি, আমার সরকারের কার্যক্রমের সুফল এক পক্ষ ভোগ করেছে, অন্যরা বঞ্চিত হয়েছে। আমি তাদের কাছে অনুরোধ করছি আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য।’ এখন তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া-না দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কিছুই যায় আসে না। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অনেক কিছু বোঝা যায় না। মালয়েশিয়ার অতি দক্ষ সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ এই সপ্তাহেই তাঁর দলের এক সম্মেলনে স্বীকার করেছেন, ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি ভুল করতে পারেন, সে জন্য দেশবাসী যেন তাঁকে ক্ষমা করে।
একটা সময় ছিল যখন শাসকদের ভুলভ্রান্তি বা অন্যায় কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ জানতে পারত না। আজ তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে মানুষ অনেক কিছু অতি দ্রুত জানছে। তাতে দ্রুততর সময়ে গঠিত হচ্ছে জনমত। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে এমন কিছু জনমত গঠিত হয়, যা সমাজকে অশান্ত করে তোলে। ইন্টারনেটের অপব্যবহারের ফলে আমাদের দেশেও বর্তমানে সে ধরনের ঘটনা ঘটছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল সম্প্রদায়ের মানুষ ও নারীদের ঝুঁকি বেশি। প্রযুক্তির কারণে সংঘটিত অপরাধ প্রতিহত করার প্রধান উপায় উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধের চর্চা। সেই মানবিক মূল্যবোধ শুধু বই পড়ে অর্জন সম্ভব নয়। পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়া খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে জরুরি শান্তি ও সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা। যে সমাজে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষিত নয়, নারী ও শিশু নিরাপদ নয়, দুর্বল ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত, সেখানে মানুষ যদি অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মধ্যেও থাকে, সে সমাজ আদর্শ সমাজ নয়।
বিগত বছরগুলোতে আমাদের সমাজে এমন কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে, যা সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ সমাজের বৈশিষ্ট্য নয়। প্রথাগত রাজনীতির কার্যকারিতা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অনাস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ জনগণের জানা নেই। কিন্তু পথ বের করতেই হবে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ভেতর থেকেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পেতে হবে। পারস্পরিক সম্মানবোধ বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রধান উপাদান। আমাদের রাজনীতিতে শ্রদ্ধাহীনতার একটি সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান বছরটি নির্বাচনের বছর হওয়ায় মানুষের মধ্যে নানা শঙ্কা লক্ষ করা যাচ্ছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র সমঝোতা ছাড়া, বিভিন্ন মতাদর্শীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়।
শুধু সুষ্ঠু নির্বাচনই সমাজে শান্তি ও রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে না। একদলীয় শাসনে যা খুশি তা-ই করা যায়, কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রতিপক্ষের যৌক্তিক দাবি অগ্রাহ্য করা যায় না। কারও অধিকার ক্ষুণ্ন করা যায় না। জনগণের আবেগ-অনুভূতির অমর্যাদা করা যায় না। নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই তাদের চিন্তাধারা ও পরিকল্পনা যদি পুনর্গঠন না করে, তাহলে দেশ দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পড়বে। দলীয় নেতারাই রাষ্ট্রের হর্তাকর্তা নন, দেশের ভালো-মন্দ শুধু তাঁরাই ভালো বোঝেন, তা নয়। ইন্টারনেটের অপব্যবহার নিয়ে বিশ্বনেতারা চিন্তিত। তা সত্ত্বেও যে লাখ লাখ মানুষ আজ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, তাদের মধ্যে বহু মানুষ চিন্তাশীল। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ। তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ, ন্যায়-অন্যায় বোধ ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা যথেষ্টই। তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করা সুবুদ্ধির কাজ হবে না।
মহান সাধক লালন ফকির গান বেঁধেছেন, ‘সত্য বল, সুপথে চল, ওরে আমার মন…….’